গ্যাংটক সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৫,৪১০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ছবির মতো সুন্দর এক শহর। হিমালয় পর্বতমালার উঁচু উঁচু চূড়ার মাঝখানে মনোরম ও আরামদায়ক পরিবেশের এই শহরে গতকাল রাতেই আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আজ আমরা গ্যাংটক শহরের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান গুলো পরিদর্শন করবো যা, গ্যাংটক সাইটসিইং (Gangtok Sightseeing) নামে পরিচিত। সিকিম ভ্রমণ কাহিনীর এই পর্বে আমি আমার গ্যাংটক ভ্রমণ কাহিনী তথা গ্যাংটক ভ্রমণ এর অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো।
এম. জি. মার্গ এ সকালের নাস্তা
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ১০ টার মধ্যে আমরা চলে আসি এম. জি. মার্গ। এটি গ্যাংটকের সব থেকে আকর্ষণীয় জায়গা। বেশিরভাগ হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান-পাঠ, এটিএম বুথ এখানেই অবস্থিত। দুইপাশে সুসজ্জিত দোকানপাঠ, মাঝখানে সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো বসার জায়গায়, পরিছন্ন হাঁটার পথ এক কথায় অসাধারণ এই এম. জি. মার্গ।
মহারাজা সুইটস এন্ড স্নাক্স নামের এক রেস্টুরেন্টে আমরা সকালের নাস্তা করি। এখানে পরোটা, সবজি, সমুচা, পুরি, ছোলা-বাটোরা, দোসা, চা, কফি, সুইটস ইত্যাদি নানা খাবার পাওয়া যায়। আমরা সবজি, পরোটা, পুরি এবং চা খেয়েছিলাম। দাম মোটামুটি কমই ছিল। পরোটার সাথে সবজি থাকে। আর এক প্লেটে ২ টা পরোটা থাকে। তাই অর্ডার করার পূর্বে প্লেটে কয়টা থাকবে, কি কি থাকবে তা জেনে নিবেন। নাহলে ঝামেলায় পড়বেন। আমি না বুঝে বেশি অর্ডার করে ফেলেছিলাম।
গ্যাংটক ভ্রমণ এর ট্যাক্সি
নাস্তা করে আমরা চলে যাই গ্যাংটক পুলিশ হেড কোয়ার্টার এর কাছে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। সেখানে আগেই থেকেই আমাদের টিমের বাকি লোকজন অপেক্ষা করছিলো। গ্যাংটকে ঘুরার জন্য ট্যাক্সি সাধারণত এখানেই পাওয়া যায়। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে গ্যাংটক শহরের দর্শনীয় স্থান গুলো ভ্রমণের জন্য আমরা দুইটি ছোট গাড়ি বা ট্যাক্সি ভাড়া করে নেই। প্রতি গাড়ির ভাড়া নিলো ২০০০ রুপি। ট্যাক্সি ভাড়া মোটামুটি এমনই। তবুও আপানারা একটু দরদাম করে নিবেন। আর কোথায় কোথায় যাবেন বলে নিবেন।
গ্যাংটকের দর্শনীয় স্থান
গ্যাংটক শহরে দেখার মতো বেশ কয়েকটি সুন্দর জায়গা বা ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে। তবে ৭ থেকে ৮ টি স্পট গেলেই মোটামোটি ভাবে গ্যাংটক ট্যুর কমপ্লিট হয়ে যায়। আমরা ৭ টি স্পট যাবো ঠিক করি। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের গাইড। উনি আমাদের গ্যাংটকের ৭ টি স্পট ঘুরে দেখবেন। আমাদের টিম মেম্বার ৮ জন। তাই ৪ জন করে একেক ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। গ্যাংটক শহরের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ট্যাক্সি এগিয়ে যেতে থাকে।
ট্যুরিস্ট স্পটে ট্যাক্সি থেকে নামার সময় গাড়ির নাম্বার প্লেটের ছবি তুলে নিবেন, ড্রাইভারের নাম্বার নিয়ে নিবেন। তা নাহলে ঘুরা শেষে ট্যাক্সি খুঁজে পেতে ঝামেলা হবে। আমি কোথাও গেলে সব সময় এই নিয়ম ফলো করি।
বাকথাং ওয়াটারফলস
অল্প কিছুক্ষন পর আমাদের ট্যাক্সি একটি ঝর্ণার সামনে থামে। এর নাম বাকথাং ওয়াটারফলস (Bakthang Waterfall)। ঝর্ণাটি দেখতে খুবই সুন্দর। চারপাশ সবুজ গাছপালায় ভর্তি। তবে শীতকাল হবার কারণে পানির প্রবাহ কম ছিল। আমরা সবাই ট্যাক্সি থেকে নেমে ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এখানে ১০০ রুপি দিয়ে জিপলাইনিং করা যায়। জায়গাটি বেশ ছোট হবার কারণে জিপলাইনিং এর ব্যাপারে আর আগ্রহী হলাম না।
ঝর্ণার কাছে ১০০ রুপি দিয়ে সিকিমের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ভাড়া পাওয়া যায়। অনেককেই দেখলাম ওই পোশাক পরে ছবি তুলছে। উনারা অনেক চাপাচাপি করলো। আমার মেয়েদেরকে ওই পোশাক পরিয়ে ছবি তুলতে বললো। সময় কম থাকার কারণে আমরা কেউ আগ্রহ দেখলাম না। পরে মনে হলো পোশাক ট্রাই করা উচিৎ ছিল।
এখানে একটি ছোট মন্দির এবং রেস্টুরেন্ট আছে। চাইলে হালকা নাস্তা করতে পারেন। ঝর্ণা থেকে আমার ঝর্ণার সামনের ভিউ বেশি ভালো লেগেছে। ৩০ মিনিটের মতো এখানে থেকে আমরা আবার পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
গণজাং মনাস্ট্রি
এর পর আমরা আসি গণজাং মনাস্ট্রি (Gonjang Monastery)। এটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় বা বৌদ্ধ বিহার। পাহাড়ের কোলে এই মনাস্ট্রি ১৯৮১ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে প্রবেশ করতে জনপ্রতি ২৫ রুপি দিয়ে টিকেট কাটা লাগে। আমরা সবার জন্য টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করি। প্রধান সড়ক থেকে পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেটে বেশ খানিকটা নিচের দিকে নেমে যেতে হয়।
এই মনাস্ট্রি অনেক বড়। বিল্ডিং গুলো তিব্বতীয় ধাঁচে নির্মাণ করা হয়েছে। যা দেখতে খুবই সুন্দর। এর চারপাশের ভিউ খুবই অসাধারণ। ভিতরে ওয়াশরুম এবং খাবার পানির ব্যবস্থা আছে। এখানে ছবি তুলতে কোনো বাধা নেই। তাই আমরাও প্রচুর ছবি তুললাম। প্রায় ঘন্টা খানেক এখানে থেকে আমরা আবার এগিয়ে চললাম।
তাশি ভিউ পয়েন্ট
এর পর আমরা আসি তাশি ভিউ পয়েন্টে (Tashi View Point)। এটি গ্যাংটকের সব থেকে আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট। এখান থেকে গ্যাংটক শহর এবং হিমালয় পর্বতমালার বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং সিনিওলচু পর্বতের সুন্দর প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায়। আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। জায়গাটি আসলেই খুবই অসাধারণ সুন্দর। আকাশ পরিষ্কর থাকায় আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেলাম। জন প্রতি ৩০ রুপি দিয়ে বাইনোকুলার দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আরো কাছ থেকে দেখলাম।
এতদিন ছবিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি। আজ এতো কাছ থেকে দেখে খুব ভালো লেগেছে। এটি আমার গ্যাংটক ভ্রমণ কাহিনী এর সব থেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা আসলেই খুব সুন্দর। এখানে একটা টাওয়ার আছে। জনপ্রতি ১০ রুপি দিয়ে আমরা টাওয়ারের উপরে উঠে গেলাম। উপর থেকে আশেপাশের ভিউ আরো বেশি সুন্দর। টাওয়ারে বসে বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা আছে। ইচ্ছে করলে এখান থেকে সিকিমের ট্রাডিশনাল জিনিসপত্র কিনতে পারেন।
লাসা ওয়াটারফলস
আমরা এর পর আসি লাসা ওয়াটারফলস (Lhasa Waterfall)। এটি একটি ছোট ঝর্ণা। তবে এখানে পানি খুব কম থাকায় আমরা গাড়ি থেকে আর নামি নাই। বর্ষাকালে এখানে পানি থাকে।
অর্গানিক ভিউ পয়েন্ট
আমরা এর পর আসি অর্গানিক ভিউ পয়েন্ট (Organic View Point)। জায়গাটি বেশ ছোট। তবে এখানকার চারপাশের ভিউ খুবই সুন্দর। এখানে বেঞ্চে বসে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে। আমরা এখানে বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম। ছবি তোলার সময় সাবধান থাকবেন। নিচের দিকটা বেশ খাড়া এবং ঢালু। এখানে কিছু খাবারের দোকান আছে।
গণেশ টক
এর পর আমরা যাই গণেশ টক (Ganesh Tok)। এটি একটি হিন্দু মন্দির। এখানে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। আমরাও জুতা খুলে উপরে উঠে যাই। জায়গাটি আমার কাছে খুব একটা ভালো লাগে নাই। উপরে বসার ব্যবস্থা আছে।
স্পুকি হাউজ
গণেশ টকের পাশেই একটি ভুতের বাড়ি আছে। এর নাম স্পুকি হাউজ (Spooky House)। সাথে বাচ্চা থাকার পরেও টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করি। টিকেটের মূল্য জনপ্রতি ১০০ রুপি। জায়গাটি সেই। অন্ধকার ঘরে লাইটের চিহ্ন দেখে দেখে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। চারদিক থেকে ভুতের নানা রকম ভয়ঙ্কর শব্দ শুনতে পেলাম। লক্ষ করলাম ভুতের ড্রেস পরে কয়েকজন চিপায় দাঁড়িয়ে আছে ভয় দেখার জন্য। মাঝে মধ্যে হটাৎ এটা ওটা সামনে চলে আসলো। পাশ কেটে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার মেয়েরা খুব ভয় পেয়েছিলো। তবে আমার কাছে ভালোই লেগেছে।
হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক
গণেশ টকের পাশেই হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক (Himalayan Zoological Park)। আমাদের প্যাকেজে এটি না থাকার পরেও আমরা ভুল করে টিকেট কেটে ফেলি। পরে শুনি এখানে গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। কি আর করা। ড্রাইভারকে অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করি। তবে হেটেও যাওয়া যায়। এক জুটিকে দেখলাম হেঁটেই যাচ্ছে।
জায়গাটি বিশাল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে। এখানে বেশ কিছু পশু পাখি আছে। তবে আয়তন হিসাবে পশু-পাখির সংখ্যা খুবই নগন্য। ভিতরে বেশ কিছু সিকিমের স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা হলো। উনারা পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছে। উনাদের কাছ থেকে সিকিমের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারলাম।
আপনাদের হাতে সময় কম থাকলে এখানে আসার দরকার নাই। অনেকের কাছে জায়গাটি ভালো নাও লাগতে পারে। খরচ হিসাবে জায়গাটি আমার কাছে আহামরি তেমন কিছু মনে হয় নাই। তবে বিশাল বিশাল গাছপালা, শান্ত পাহাড়ি পথ বেশ ভালো লেগেছে। ভল্লুক, রেড পান্ডা, চিতাবাঘ, নীল গাই দেখে আমরা ফিরে আসি গ্যাংটক।
দুপুরের লাঞ্চ
দুপুর ৩ টার দিকে আমরা গ্যাংটক শহরে ফিরে আসি। ঢাকায় থাকতেই আসলাম ভাইয়ের বিরিয়ানির কথা শুনেছি। তাই চলে আসলাম আসলাম ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে। গ্যাংটকে যতগুলো হালাল খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। তাই এখানে ভীড় একটু বেশি থাকে। আর খাবার তারারি শেষ হয়ে যায়। একটু দেরিতে আসায় আমরাও সব আইটেম পেলাম না।
এখানে বিরিয়ানি বেশ সস্তা। আমরা তেহারি খেলাম। টিমের অন্যরা মাটন বিরিয়ানি খেয়েছিলো। বিরিয়ানির টেস্ট দারুন ছিল। রেস্টুরেন্টে বসার জায়গা বেশ ছোট। আর গরম পানির ব্যবস্থা না থাকায় খাবার খেয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত ধুতে গিয়ে খবর হয়ে যায়।
গ্যাংটক ভ্রমণ শেষে
খাবার খেয়ে সবার শরীর খুব ক্লান্ত হয়ে পরে। তাই গ্যাংটক রোপওয়েতে (Gangtok Ropeway) না গিয়ে সরাসরি হোটেলে চলে আসি। গ্যাংটক রোপওয়ে আমাদের প্যাকেজ এর মধ্যে ছিল। এটি গ্যাংটক শহরেই অবস্থিত। তাই অন্য এক সময় যাবো প্ল্যান করি। হোটেলে এসে ঘুম দেই। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে রাতের গ্যাংটক শহর ঘুরে দেখবো এবং নর্থ সিকিম যাবার প্যাকেজ নিবো।
গ্যাংটক ভ্রমণ এর সতর্কতা এবং পরামর্শ
- সকাল সকাল জার্নি শুরু করবেন।
- ট্যাক্সি থেকে নামার পূর্বে ড্রাইভারের ফোন নাম্বার নিয়ে নিবেন।
- খাবার অর্ডার করার পূর্বে প্লেট বা থালিতে কি কি থাকবে জেনে নিবেন।
- গ্যাংটকে পানির বোতল সব ২ লিটার। তাই সাথে পানির পট রাখবেন।
- স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।
- সিকিমের ট্র্যাডিশনাল ড্রেস পরে ছবি তোলার চেষ্টা করবেন।
- কোনো জায়গা না চিনলে স্থানীয়দের সাহায্য নিন।
সিকিম ভ্রমণের গল্প
আমার গ্যাংটক ভ্রমণ কাহিনী আপনাদের কেমন লাগলো জানাবেন। আমার সিকিম ভ্রমণের আরো অভিজ্ঞতা জানতে বাকি পর্ব গুলো দেখে নিতে পারেন। আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে।
- পর্ব ১: ঢাকা থেকে গ্যাংটক
- পর্ব ৩: নর্থ সিকিম ভ্রমণ প্যাকেজ
- পর্ব ৪: গ্যাংটক থেকে নর্থ সিকিম
- পর্ব ৫: ইয়ুমথাং ভ্যালি এবং জিরো পয়েন্ট
- পর্ব ৬: ছাঙ্গু লেক ভ্রমণ
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।