লাদাখ (Ladakh) উত্তরে কুনলুন আর দক্ষিণে হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত বিশাল এক অঞ্চল। বিশাল আকৃতির কালারফুল উঁচু উঁচু পাহাড়, শীতল মরুভুমি, মেঘহীন নীল আকাশ, সবুজ উপত্যকা, বরফে ঢাকা চূড়া, জনমানবহীন প্রান্তর, পাহাড়ি নদী, সব মিলিয়ে লাদাখ প্রকৃতির এক অপূর্ব মিলনমেলা। তাই তো দুঃসাহসিক, রোমাঞ্চকর ভ্রমণ পিপাসুদের এক আদর্শ স্থান এই লাদাখ।
লাদাখের ইতিহাস
লাদাখের ইতিহাস খুবই করুন। বিভিন্ন রাজা বিভিন্ন সময় লাদাখ আক্রমণ করেছেন, শাসন করছেন। যার ফলে লাদাখের আয়তন কখনো সংকুচিত আবার কখনো প্রসারিত হয়েছে। খোদাই করা বিভিন্ন প্রস্তরখন্ড থেকে জানা যায় যে নব্য প্রস্তর যুগেও লাদাখে মানুষের বসবাস ছিল।
প্রথম শতাব্দীতে লাদাখ কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বত সাম্রাজ্যের পতন হলে, শেষ তিব্বত সম্রাট লাদাখকে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং লাদাখি রাজবংশের সুত্রপাত করেন। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মীরের ডোগরা সেনাপতি, জোরাওয়ার সিং কাহলুরিয়া, লাদাখ আক্রমণ করেন এবং লাদাখকে কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলে, কাশ্মীরের ডোগরা শাসক হরি সিং, কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন পাকিস্তান, কাশ্মীর রাজ্যের অনেক অংশ দখল করে নেয়। যার ফলে দুই দেশের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়।
এক পর্যায়ে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ শেষ হয়। তখন কাশ্মীর রাজ্যের কিছু অংশ পাকিস্তান কে (আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তান), কিছু অংশ ভারতকে (জম্মু ও কাশ্মীর এবং বর্তমান লাদাখ) দিয়ে দেয়া হয়। কিছু অংশ চায়নার (আকসাই চিন) কাছেও চলে যায়।
এক সময় বিশাল এলাকা (বালতিস্তান উপত্যকা, সিন্ধু নদ উপত্যকা, আকসাই চিন) থাকলেও বর্তমানে লাদাখ কেবল লেহ এবং কার্গিল জেলা নিয়ে গঠিত। এখানে তিব্বতীয় সংস্কৃতির প্রভাব অনেক বেশি বলে একে ক্ষুদ্র তিব্বতও বলা হয়।
লাদাখ এর দর্শনীয় স্থান
লাদাখ অনেক সুন্দর এবং বিশাল। এর উল্লেখ যোগ্য দর্শনীয় স্থান গুলো হলো:- নুব্রা ভ্যালি, প্যাংগং লেক, খারদুংলা পাস, তুর্তুক ভিলেজ, শান্তি স্তুপা, লে প্যালেস, সে প্যালেস, থিকসে মনাস্ট্রি, থ্রি ইডিয়টস স্কুল, সঙ্গম পয়েন্ট, গুরুদুয়ারা পাথর সাহেব, হল অফ ফেম, ম্যাগনেটিক হিল, মুনল্যান্ড, লামায়ুরু মনাস্ট্রি, কার্গিল শহর, দ্রাস শহর ইত্যাদি।
নুব্রা ভ্যালি, প্যাংগং লেক, খারদুংলা পাস, তুর্তুক ভিলেজ লেহ শহরের উত্তর দিকে পড়েছে। এবং এখানে যেতে হলে সব দেশের (ইন্ডিয়ান সহ) নাগরিকদের লেহ ডিসি অফিস থেকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সহ আরো কিছু দেশের জন এই অনুমতি দেয়া লেহ ডিসি অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। তাদেরকে নিজ দেশে অবস্থিত ইন্ডিয়ান হাইকমিশন থেকে অনুমতি নিতে হয়।
এই বিশেষ অনুমতির জন্য একেক সময় একেক নিয়ম থাকে। একবার বন্ধ থাকে তো আবার খুলে। তাই যাবার আগে কোন জায়গা থেকে, কিভাবে নিতে হয় জেনে যাবেন। নুব্রা ভ্যালি, প্যাংগং লেক, তুর্তুক ভিলেজ যেতে হলে কমপক্ষে তিন দিন সময় লাগবে। খারদুংলা পাস নুব্রা ভ্যালি যাবার পথে পরে।
লাদাখ কিভাবে যাবেন
যেকোনো ট্যুরেই একা থেকে দলবদ্ধ ভাবে গেলে অনেক বেশি মজা হয়, আর খরচ ও কমে যায়। দল বা টিমের সাইজ ৪ বা ৬ গুণিতক হলে ভাল। তাহলে নিরাপত্তা নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করা লাগেনা এবং হোটেল বুকিং, গাড়ি ভাড়া করতে সুবিধা হয়। লাদাখ যেতে হলে প্রথমেই আপনার থাকতে হবে ভারতীয় ট্যুরিস্ট ভিসা। ভারতের ভিসা থাকলে আপনি বিভিন্ন ভাবে ঢাকা থেকে কাশ্মীর যেতে পারেন।
রুট ০১:
ঢাকা থেকে প্লেনে দিল্লি। সেখান থেকে কাশ্মীর যেতে চাইলে ডমেস্টিক প্লেনে শ্রীনগর, লাদাখ যেতে চাইলে লেহ। এতে খরচ একটু বেশি পরে। তবে সময় অনেক কম লাগে। ঢাকা থেকে কাশ্মীর/লাদাখের সরাসরি কোনো ফ্লাইট আপাদত নাই।
রুট ০২:
ঢাকা থেকে সড়ক পথে বাস/ট্রেন এ কলকাতা বা আগরতলা। সেখান থেকে ডমেষ্টিক প্লেনে দিল্লি। পরে দিল্লি থেকে শ্রীনগর/লেহ। এতে খরচ একটু কম হয়। তবে কলকাতার পরিবর্তে আগরতলা হয়ে গেলে ভাল। এতে সময় কম লাগে। কলকাতা থেকে দিল্লি প্লেনে যে ভাড়া আগরতলা থেকে একই ভাড়া। ঢাকা থেকে আগরতলা যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘন্টা, যেখানে কলকাতা যেতে লাগে প্রায় ১২ ঘন্টা।
রুট ০৩:
ঢাকা থেকে সড়ক পথে বাস/ট্রেন এ কলকাতা। সেখান থেকে ট্রেনে দিল্লি। দিল্লি থেকে শিমলা মানালি হয়ে লেহ। এতে খরচ অনেক কম পরে। তবে আপনার হাতে যদি যথেষ্ট সময় থাকে ও একটু অ্যাডভাঞ্চারাস হন তাহলেই কেবল এ রুটে যাবেন। এ ক্ষেত্রে আপনাকে অন্তত ৪৮০ কি. মি. জার্নি করার মত মানসিক ও শারীরিক শক্তি থাকতে হবে। তবে, এই গ্যারান্টি দিতে পারি যে এটাই হবে আপনার জীবনের সব থেকে সেরা ভ্রমণ। এতে আপনাকে বেশ কয়েকটা ১৫,০০০+ ফিট উঁচু পাস্ পার হয়ে যেতে হবে। তবে এই রুট বছরে মাত্র ছয় মাস খোলা থাকে, মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
আপনার সময় এবং বাজেটের উপর নির্ভর করে আপনি আপনার জন্য উপযুক্ত রুট চয়েজ করবেন। তবে প্রত্যেক রুটেই আলাদা মজা। আর প্লেনে যেতে চাইলে সম্ভব হলে কমপক্ষে ৬০ দিন আগে টিকেট কেটে নিবেন। তাহলে অনেক সস্তায় টিকেট পেতে পারেন। বিভিন্ন টিকেট বুকিং সাইট অথবা বিভিন্ন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স এর ওয়েব সাইট থেকে সহজেই টিকেট কাটা যায়। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেইমেন্ট করে দিবেন। তবে টিকেট কাটার আগে বেশ কয়েকটা এয়ারলাইন্স এ অবশ্যই দাম কম্পেয়ার করে নিবেন। টিকিটের মূল্য একেক এয়ারলাইন্স এ একেক সময় একেক রকম থাকে।
লাদাখ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
লাদাখ খুবই দুর্গম এবং মারাত্মক ঠান্ডা এলাকা। শীতকালে এই ঠান্ডার পরিমান অনেক বেড়ে যায়। মে থেকে অক্টোবর এই ছয় মাস লাদাখে বেড়ানোর সব থেকে ভাল সময়। কারণ এসময় ঠান্ডা একটু কম থাকে এবং আবহাওয়া খুব ভালো থাকে। এই সময়ে লাদাখে পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে।
শীতকালে (নভেম্বর – এপ্রিল) লাদাখে মারাত্বক ঠান্ডা পরে এবং বরফ জমে অনেক রাস্তা ঘাট বন্ধ হয়ে যায়। তখণ গেলে ঠান্ডা মোকাবেলা করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যাবে, তেমন কিছু দেখা যাবে না। তাছাড়া এসময়ে প্রায় ৯০% হোটেল বন্ধ থাকে। ফলে থাকা ও খাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে। তাই শীতকাল লাদাখে বেড়ানোর ভাল সময় নয়।
লাদাখ ভ্রমণের প্রস্তুতি
লাদাখ ভ্রমণ করতে হলে বেশ টাকাপয়সা আর সময় লাগে। তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া ভালো। মোটামোটি ছয় মাস আগে থেকেই প্ল্যান করে ফেলুন। সার্ভিস হোল্ডার হলে যে বছর যাবেন সে বছরকার ছুটি হুদাই শেষ না করে এ সময়ের জন্য বাঁচিয়ে রাখুন। আগে থেকে বলে ছুটির ব্যবস্থা করে ফেলুন। প্রতিমাসে অল্প অল্প করে কিছু টাকা সেইভ করার চেষ্টা করুন।
কম পক্ষে ২-৩ মাস আগে প্লেনের টিকেট কেটে ফেলুন। তার পরের মাসে শীতের জন্য জামাকাপড়, জুতা ইত্যাদি দরকারি জিনিসপত্র কিনে ফেলুন। তাহলে একবারে খুব বেশি প্রেসার পড়বেনা। লাদাখে চলাফেরা করার জন্য শারীরিক ভাবে একটু ফিট থাকা লাগে। তাই যাবার ২-৩ মাস আগে থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০-৩০ মিনিট ব্যায়াম করে নিজেকে শারীরিক ভাবে উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করুন।
কোথায় থাকবেন
লাদাখ অনেক বড়। আপনি যে এলাকায় যাবেন, সেখানেই থাকার চেষ্টা করবেন। সব ট্যুরিস্ট স্পটের আশেপাশেই থাকার ব্যবস্থা আছে। হোটেলে রুম ভাড়া নেবার আগে অবশ্যই দেখে নিবেন এবং দরদাম করে নিবেন। লেহ শহরে থাকতে চাইলে , সম্ভব হলে পুরাতন টাউন এর দিকে থাকার চেষ্টা করবেন। তাহলে শাসকষ্ট একটু কম হবে। এখানে কোনো হোটেলেই A/C কিংবা ফ্যান নাই। আর দরকার ও নাই। তবে গরম পানির ব্যাবস্থা আছে কিনা দেখে নিবেন। না হলে শেষ। ট্যাক্সি ভাড়া করার আগে দামাদামি করে নিবেন।
লাদাখ ভ্রমণের সতর্কতা
লাদাখের গড় উচ্চতা সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১৫০০ ফিট। অনেক জায়গার উচ্চতা আরো বেশি। এখানে সবসময়ই মারাত্মক ঠান্ডা থাকে। লাদাখ মূলত একটি মরুভুমি, যেখানে গাছপালা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমান অনেক কম। বাতাসে অক্সিজেন লেভেল খুবই কম।
অতি উচ্চতা, অতিরিক্ত ঠান্ডা, আর অক্সিজেন কম থাকার কারণে বাংলাদেশিদের মতো লো ল্যান্ডের মানুষদের AMS – একিউট মাউন্টেইন সিকনেস দেখা দিতে পারে। AMS এর লক্ষণ গুলো হলো: মাথা ঘুরানো, দুর্বল লাগা, বমি বমি ভাব, মাথা ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
কিন্তু ঘাবরানোর কিছু নাই। যাবার আগে কিছু প্রস্তুতি আর যাবার পর কিছু নিয়ম মেনে চললে AMS থেকে রক্ষা পাওয়ায় যায়। লেহ শহরে পৌঁছে হোটেলে কমপক্ষে ১/২ দিন ফুল রেস্টে থাকতে হবে। ঘন ঘন পানি খেতে হবে। পানি দেহে অক্সিজেনের লেভেল বাড়ায়।
লেহ এর সব ফার্মেসিতে অক্সিজেনের মিনি ক্যান পাওয়া যায়। কেউ সমস্যা মনে করলে ২-১ টা কিনে নিবেন। দাম ১২০০ রুপির মতো। এর পরেও কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাথে সাথে হাসপাতালে যেতে হবে। এছাড়াও একধরণে ট্যাবলেট পাওয়া যায় যা দেহে অক্সিজেন লেভেল বাড়ায়। ডাক্তারের পরামর্শে যাবার ২-১ দিনে আগে থেকে গ্রহণ করতে পারেন।
লাদাখ খুবই উঁচু এবং দুর্গম এলাকা। এখানে বছরে ছয় মাস ঠান্ডার কারণে প্রায় সব কিছু বন্ধ থাকে। যাবার আগে অবশ্যই সঠিক সময় জেনে নিবেন। এখানে চলাফেরা করার জন্য শারীরিক ভাবে বেশ ফিট থাকতে হবে। হাঁপানি, শাসকস্ট থাকলে না যাওয়াই উত্তম। যাবার ২-৩ মাস আগে থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০-৩০ মিনিট ব্যায়াম করে নিজেকে শারীরিক ভাবে উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করুন।
লাদাখ একটি সীমান্তবর্তী এলাকা। তাই এখানে নিরাপত্তা একটু বেশি। একটু পর পর আর্মি ক্যাম্প আর সবসময় রাস্তায় আর্মিদের ট্রাক চলাচল করতে দেখা যায়। তাই সবসময় পাসপোর্ট, যে হোটেলে ওঠেছেন তার ফোন নাম্বার, ঠিকানা সাথে রাখবেন। লাদাখে সরকারি BSNL এর লাইন ছাড়া অন্য মোবাইল অপারেটরদের লাইন কাজ করেনা। দেশে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম ইন্টারনেট। যদিও তার স্পিড খুবই কম। তাই হোটেলে উঠার আগে অবশ্যই ওয়াইফাই আছেকিনা জেনে নিবেন।
পরিশেষে
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।