সাজেক ভ্যালি (Sajek Valley) নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি যা বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর এবং জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। এখানে প্রকৃতি ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়। কখনো শীত আবার কখনো বর্ষা। চোখের পলকেই চারপাশ ঢেকে যাবে সাদাকালো মেঘে। এ যেন মেঘের উপত্যকা। নিজেকে মনে হবে মেঘের রাজ্যের বাসিন্দা।
সাজেক কোথায় অবস্থিত
সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার, বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে অবস্থিত। সাজেক বাংলাদেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন, যার আয়তন প্রায় ৭২০ বর্গমাইল। এটি ভারতের ত্রিপুরা-মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফুট।
সাজেক রাঙ্গামাটি জেলায় হলেও খাগড়াছড়ি হয়ে এখানে যাতায়াত বেশি সুবিধাজনক। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক এর তুরুত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ির দিঘীনালা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪৯ কিলোমিটার। বাঘাইহাট থেকে থেকে ৩৪ কিলোমিটার। তাই সবাই সাধারণত দিঘীনালা থেকেই সাজেক যেতে পছন্দ করে।
সাজেকে কি করবেন
সাজেক এক আশ্চর্যজনক জায়গায় যেখানে এক দিনেই আপনি তিন রকমের আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে পারেন। কখন খুব গরম অনুভব করবেন। আবার একটু পরেই বৃষ্টি এসে সব ভিজিয়ে দিবে। কিংবা কখনো সাদা মেঘ এসে সব কিছু ঢেকে দিবে। চারপাশে মনোরম সারি সারি পাহাড়, সাদা মেঘের আনাগোনা দেখার জন্য সাজেক এক আদর্শ জায়গা।
সাজেকের সবশেষ গ্রাম কংলক পাহাড়। যা সাজেক ভ্রমণে আসা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। এটি লুসাই জনগোষ্ঠী অধুষ্যিত পাড়া। এখানকার কংলক পাহাড় থেকে কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। তবে সাজেক বিজিবি ক্যাম্প এর পর আর কোনো ক্যাম্প না থাকায় অনেক সময় নিরাপত্তাজনিত কারণে কংলক পাড়া যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না।
সাজেকের রুইলুই পাড়া থেকে ২ ঘন্টা ট্রেকিং করে দেখে আসতে পারেন কমলক ঝর্ণা। এটি দেখতে খুবই সুন্দর। অনেকের কাছে এটি পিদাম তৈসা ঝর্ণা বা সিকাম তৈসা ঝর্ণা নামেও পরিচিত।
সাজেক কখন যাবেন
সাজেক অপরূপ সুন্দর। সারা বছরই এর সৌন্দর্য বজায় থাকে। তাই বছরের যে কোনো সময় আপনি এখানে আসতে পারেন। তবে জুলাই থেকে নভেম্বর এখানকার আকাশে মেঘের পরিমান বেশি থাকে। তাই মেঘের খেলা দেখতে চাইলে এই সময় আসা উত্তম।
সাজেক কিভাবে যাবেন
সাজেক ভ্যালি যেতে হলে প্রথমেই আসতে হবে খাগড়াছড়ি জেলায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ভাবে সাজেক আসা যায়। ঢাকা থেকে শ্যামলী, হানিফ, সৌদিয়া, সেন্টমার্টিন পরিবহন, এস আলম, বিআরটিসি ইত্যাদি বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির এসি/নন এসি বাস খাগড়াছড়ি আসে। নন এসি বাস ভাড়া ৭৫০। তবে শান্তি পরিবহন দিঘীনালা পর্যন্ত আসে, ভাড়া ৭৮০ টাকা।
দিঘীনালা থেকে বাঘাইহাট হয়ে সাজেক যেতে হয়। বাঘাইহাট আর্মি এবং পুলিশ ক্যাম্প থেকে অনুমতি নেয়া লাগে। এটি নেয়া বাধ্যতামূলক। পথে পরবে কাসালং ব্রিজ, টাইগার টিলা আর্মি ক্যাম্প, মাসালং বাজার। বাজার পার হলেই পরবে সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুই পাড়া। এই গ্রামের উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফুট। রুইলুই পাড়া থেকে অল্প সময়ে পৌঁছে যাবেন সাজেক।
খাগড়াছড়ি শহর অথবা দিঘীনালা থেকে লোকাল চান্দের গাড়ি/জীপগাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। এই গাড়ি রিজার্ভ করে সাজেক যাওয়া যায়। এক গাড়িতে ১০/১২ বসা যায়। একদিনে সাজেক ঘুরে চলে আসলে গাড়ি ভাড়া ৫,৪০০ টাকা। এক রাত থেকে পরের দিন আসলে গাড়ি ভাড়া ৭,৭০০ টাকা। দুই রাত থাকলে গাড়ি ভাড়া ১০,০০০ থেকে ১৩,০০০ টাকা।
দিঘীনালা থেকে সিএনজি দিয়েও সাজেক যাওয়া যায়। ভাড়া ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা। তবে সিএনজি দিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। রাস্তা বেশ ঢালু, তাই উল্টে যাবার সম্ভবনা আছে। অনেক সময় তারা মাঝপথে আর যেতে পারবেনা বলে অন্য গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। এছাড়া কম টাকায় যেতে চাইলে প্রথমে খাগড়াছড়ি শহর থেকে বাসে দিঘীনালা, ভাড়া ৫০ টাকা। দিঘীনালা থেকে মোটরসাইকেলে সাজেক, ভাড়া ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। তবে ফেরার পথে বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্প সন্ধ্যার আগেই পার হতে হবে। তা নাহলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন।
সেনাবাহিনীর এসকোর্ট কখন শুরু হয়
দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকোর্ট শুরু হয়। প্রতিদিন ২ টি এসকোর্ট পরিচালনা করা হয়। প্রথম এসকোর্ট সকাল ১০ টায়, দ্বিতীয় এসকোর্ট বিকাল ৩ টায়। একই ভাবে সাজেক থেকে প্রথম এসকোর্ট সকাল ১০ টায়, দ্বিতীয় এসকোর্ট বিকাল ৩ টায়। আপনাকে এই এসকোর্ট এর সাথেই যেতে আসতে হবে। মিস করলে ওই দিন থেকে পরের দিন আবার ধরতে হবে।
প্রাইভেট কার নিয়ে সাজে
আপনি চাইলে আপনার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সাজেক যেতে পারেন। এর জন্য কোনো অতিরিক্ত ফর্মালিটিজ নাই। এ ক্ষেত্রে জিপ গাড়ি হলে ভালো। মোটর সাইকেল নিয়েও যেতে পারেন। তবে মনে রাখবেন খাগড়াছড়ির পরে আর কোনো ফিলিং স্টেশন নাই।
কোথায় থাকবেন
সাজেকে থাকার জন্য বেশ কিছু রিসোর্ট এবং আদিবাসীদের কটেজ আছে। প্রতি রাতের জন্য ভাড়া ২০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা। ছুটির দিন গুলোতে ভিড় একটু বেশি থাকে। তাই ভালো রিসোর্ট পেতে চাইলে এক মাস আগে থেকে বুকিং দিয়ে গেলে ভালো।
এছাড়া কম খরচে আদিবাসীদের কটেজে থাকা যায়। এখানের সব রিসোর্ট, কটেজ থেকেই মোটামোটি সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। আগের থেকে রিসোর্ট, কটেজ এর সংখ্যা বাড়ায় এখন আগের মতো আর থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা হয় না।
সাজেকের রিসোর্ট, কটেজ
সাজেকে থাকার জন্য কিছু রিসোর্ট ও কটেজ এর বিস্তারিত নিচে দেয়া হলো:
সাজেক রিসোর্ট (Sajek Resort)
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এটি পরিচালনা করে। ভাড়া ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা। খাবারে ব্যবস্থা আছে। সেনাবাহিনিতে কর্মরত বা প্রথম শ্রেনীর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্যে ডিসকাউন্ট এর ব্যবস্থা আছে। ফোন: ০১৮৫৯-০২৫৬৯৪, ০১৮৪৭-০৭০৩৯৫, ০১৭৬৯-৩০২৩৭০
রুন্ময় রিসোর্ট (Runmoy Resort)
এই রিসোর্টে মোট ৫ টি রুম আছে। নিচ তলায় আছে ৩ টি রুম। রুম ভাড়া ৪,৪৫০ টাকা। প্রতি রুমে ২ জন থাকা যায়। ৬০০ টাকা দিয়ে অতিরিক্ত বেড নেয়া যায়। উপরের তলায় আছে ২ টি রুম। রুম ভাড়া ৪,৯৫০ টাকা। প্রতি রুমে ২ জন থাকা যায়। এখানে ৬০০ টাকা দিয়ে অতিরিক্ত বেড নিতে পারেন। ফোন: ০১৮৬৫৪৭৬৮৮
মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট (Meghpunji Resort)
সুন্দর ইকো ডেকোরেশনের ও আকর্ষণীয় ল্যান্ডস্কেপিক ভিউ সম্বলিত এই রিসোর্টে আছে ৪টি কটেজ। প্রতিটি কটেজে ৪ জন থাকা যায়। ভাড়া ৪,০০০ থেকে ৪,৫০০ টাকা। ফোন: ০১৮১৫-৭৬১০৬৫। ফেসবুক পেইজ
আরো পড়তে পারেন সাজেকের সকল রিসোর্ট এবং কটেজ এর তথ্য।
কোথায় খাবেন
সাজেক ভ্যালিতে সব রিসোর্ট, কটেজেই খাবারের ব্যবস্থা আছে। আগে থেকে বলে রাখলে পছন্দ মতো খাবার রান্না করে দিবে। ভাত, আলুভর্তা, মুরগির মাংস ইত্যাদি খেলে প্রতিবেলা খরচ হতে পারে ১০০ থেকে ২৫০ টাকা। ইচ্ছে করলে রাতে বার বি কিউ করতে পারেন। এছাড়া আদিবাসীদের ঘরেও খেতে পারেন। এখানে পেঁপে, আনারস, কলা ইত্যাদি ফল খুব কম দামে পাওয়া যায়। একদম ফ্রেশ আর খেতে দারুন টেস্টি। অবশ্যই খেয়ে দেখবেন।
সাজেকে এখন বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট আছে। তাদের মধ্যে চিম্বাল রেস্টুরেন্ট, ফুডানকি রেস্টুরেন্ট, মারুতি দিদির রেস্টুরেন্ট, কাশবন রেস্টুরেন্ট, মনটানার রেস্টুরেন্ট উল্লেখযোগ্য। এদের খাবার বেশ ভাল। এখানে ডাল, ভাত, সবজি দেশী মুরগী প্যাকেজ খাবার পাওয়া যায়। খরচ হবে ২০০/২৫০ টাকা।
সাজেক ভ্রমণ টিপস এবং সতর্কতা
- সাজেক যাবার পথ বেশ আঁকাবাঁকা, উঁচু নিচু এবং বিপদজনক। তাই গাড়িতে ভ্রমণ করার সময় সতর্ক থাকবেন।
- এখন এখানে বিদ্যুৎ আছে। সোলার এনার্জিও ব্যবহার করা হয়। তবে নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ পাওয়া যায় না। তাই মোবাইল, ক্যামেরা চার্জ দিতে সাথে অবশ্যই পাওয়ার ব্যাংক রাখবেন।
- এখানে সব মোবাইল অপারেটর এর নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এয়ারটেল, রবি, টেলিটক এর নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
- ছুটির দিনে গেলে আগে থেকেই রিসোর্ট বুকিং করে যাবেন।
- এখানে যেতে কোনো গাইডের প্রয়োজন হয় না।
- আদিবাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। ছবি তোলার আগে অনুমতি নিবেন।
- দুই তিন দিনের জন্য গেলে শুধু শুধু গাড়ি বসিয়ে না রেখে ছেড়ে দিন, ফেরার সময় অন্য গাড়ি ঠিক করুন। অথবা দীঘিনালা থেকে ফোন করে গাড়ি আনিয়ে নিতে পারেন।
- যাবার পথে বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে সবার তথ্য দিতে হয়। তাই টিমের সবার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, ন্যাশনাল আইডি নাম্বার একটা কাগজে প্রিন্ট করে কয়েক কপি সাথে রাখুন। সবার ন্যাশনাল আইডির কপি অবশ্যই সাথে রাখুন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।