চট্টগ্রাম বিভাগের দর্শনীয় স্থান

আমিয়াখুম জলপ্রপাত

Loading

আমিয়াখুম

আমিয়াখুম জলপ্রপাত (Amiakum Waterfall) খুম সম্রাজ্যের রানী। পাথর আর সবুজে ঘেরা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবল বেগে নেমে আসছে পানির প্রবাহ। পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে সাদা রঙের ফেনা তৈরী করছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে পাথরের চাতাল। এর সাথে যোগ হয়েছে অবিরাম পানি প্রবাহের শব্দতরঙ্গ।

আমিয়াখুম জলপ্রপাত কোথায় অবস্থিত

আমিয়াখুম জলপ্রপাত বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাশে দুর্গম নাক্ষিয়ং নামক স্থানে অবস্থিত।

আমিয়াখুম জলপ্রপাত কখন যাবেন

আমিয়াখুম সব সময়ই যাওয়া যায়। একেক সময় এর একেক রূপ। বর্ষা কালে পানির প্রবাহ বেশি থাকে। আর শীত কালে কমে যায়। কিন্তু একেবারেই ফুরিয়ে যায়না। তাই আমিয়াখুম যাওয়ার সব থেকে ভাল সময় হলো বর্ষার পর পর আর শীতের একটু আগে। মানে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে।

কেননা ভরা বর্ষায় সাঙ্গু নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি থাকায় প্রশাসন থেকে অনেক সময় অনুমতি দেয়না। জোকের প্রাদুর্ভাব একটু বেশি থাকে। পথ পিচ্ছিল হয়ে যায়, যখন তখন বৃষ্টি একটা সমস্যা তৈরী করে।

আমিয়াখুম জলপ্রপাত কিভাবে যাবেন

আমিয়াখুম যেতে হলে আপনাকে প্রথমেই আসতে হবে বান্দরবান জেলায়। তার পর সেখান থেকে থানচি উপজেলা। থানচি বাজার থেকে দুই ভাবে আমিয়াখুম যাওয়া যায়।

  • রুট ১: থানচি => পদ্মঝিরি => থুইসাপাড়া => দেবতাপাহাড় => আমিয়াখুম
  • রুট ২: থানচি => রেমাক্রি => নাফাখুম => জিনাপাড়া => থুইসাপাড়া => দেবতাপাহাড় => আমিয়াখুম

প্রথম রুটে পদ্মঝিরি যেতেই ৬/৭ ঘন্টা ট্রেকিং করা লাগে। অনেক সময় রাতের বেলায় ট্রেকিং করা লাগতে পারে। সেই হিসাবে দ্বিতীয় রুট তুলনামূলক ভাবে সহজ এবং কম কষ্টকর। তবে আপনি প্রথম রুটে গিয়ে দ্বিতীয় রুটে ফেরত আসতে পারেন।

রাজধানী ঢাকার কলাবাগান, আরামবাগ থেকে শ্যামলী, হানিফ, সেন্টমার্টিন, দেশ ইত্যাদি পরিবহন কোম্পনীর এসি, নন-এসি, হুন্দাই বাস প্রতিদিন বান্দরবান শহরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং ঢাকায় ফিরে আসে। জনপ্রতি বাস ভাড়া নন-এসি ৫৫০-৭৫০, এসি ১২০০-১৫০০ টাকা। রাতের বাসে রওনা দিলে সকাল ৭ টার মধ্যে চলে আসবেন বান্দরবান।

এছাড়া ট্রেন বা প্লেনে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এসে, চট্টগ্রাম থেকে বাস, প্রাইভেট কার নিয়ে বান্দরবান আসতে পারেন। বদ্দারহাট, ধামপাড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস পাওয়া যায়। ভাড়া ২২০ টাকা। মাইক্রোবাস ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা।

বান্দরবান থেকে থানচি

বান্দরবান থেকে থানচি বাস বা রিজার্ভ জীপ/চান্দের গাড়িতে যাওয়া যায়। বান্দরবান শহরের থানচি বাস স্ট্যান্ড থেকে এক ঘন্টা পর পর বাস ছাড়ে। জনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা, সময় নিবে ৪-৫ ঘন্টা। জীপ/চান্দের গাড়ির ভাড়া প্রশাসন থেকে ৬০০০ টাকা বেঁধে দিয়েছে। তবে চান্দের গাড়ির স্ট্যান্ডের একটু আগে থেকে নিলে ৫০০-১০০০ টাকা কমে পেতে পারেন।

টিম বড় হলে চান্দের গাড়ির নিয়ে যাওয়াই ভালো। সময় নিবে ৩-৩.৫০ ঘন্টা। এক গাড়িতে ১০-১২ জন বসা যায়। যাবার পথে মিলনছড়ি, চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি ছাড়াও চারপাশের অপূর্ব সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ দেখতে পারবেন, দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারবেন।

থানচি থেকে রেমাক্রি

থানচি বাজারে বিজিবি ক্যাম্প থেকে গাইডের তালিকা করে দেয়া আছে। সেখান থেকে আপনাকে একজন গাইড নিতে হবে, এটি নেয়া বাধ্যতামূলক। সেই দিন সাথে গিয়ে পরের দিন ফিরে আসা পর্যন্ত গাইড ভাড়া ১৫০০ টাকা। এর পর সবার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, বাসার ফোন নাম্বার, ন্যাশনাল আইডির কপি, কোথায় যাবেন, কয়দিন থাকবেন ইত্যাদি সব কাগজে লিখে থানা এবং বিজিবি ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হবে। থানায় সবার গ্রূপ ছবি তুলে রাখবে। সব ক্ষেত্রে গাইড আপনাকে সাহায্য করবে।

মনে রাখবেন বিকাল তিনটার পরে আর কোনো অনুমতি দেয়া হয় না। তাই এর আগেই আপনাকে থানচি পৌঁছাতে হবে। নাহলে সেই দিন থানচি থেকে পরের দিন রওনা দিতে হবে। ৫০ টাকা করে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া পাওয়া যায়। বর্ষাকাল হলে সবার জন্য ১ টা, না হলে অন্তত যারা সাঁতার জানেনা তাদের জন্য ১ টা করে নিয়ে নিবেন।

প্রশাসন থেকে অনুমতি পাবার পর থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করতে হবে। সেই দিন গিয়ে পরের দিন ফেরত নিয়ে আসা পর্যন্ত নৌকা ভাড়া ৪৫০০ টাকা। এটা প্রশাসন থেকে ফিক্সড করে দিয়েছ। এক নৌকায় ৪-৫ জন বসা যায়। রেমাক্রি পৌঁছাতে সময় নিবে ২.৫ ঘন্টার মতো। নদীতে পানি কম থাকলে কোথাও কোথাও একটু নেমে হেটে যেতে হতে পারে।

যাত্রাপথে সাঙ্গু নদীর অপূর্ব রূপ দেখে মুগ্ধ হবেন। এছাড়া পথেই পরবে পদ্মমুখ, তিন্দু, রাজাপাথর, বড়পাথর এবং রেমাক্রি ফলস। নিরাপত্তার কারণে সব জায়গার থামা যায় না। তবে বড়পাথর এলাকায় নেমে ছবি তুলতে পারবেন। রেমাক্রি ফলস এ নেমে গুসল করে দারুন মজা পাবেন। নদীর শীতল জল আপনার দেহ ঠান্ডা করে দিবে।

রেমাক্রি থেকে থুইসাপাড়া

রেমাক্রি পৌঁছাতে বিকাল হয়ে গেলে সেই দিন রাতে এখানে থেকে পরের দিন সকালে নাফাখুম এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। রেমাক্রি থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে আরো একজন স্থানীয় গাইড নিতে হবে যা থানচি থেকে আসা গাইড ঠিক করে দিবে। এই স্থানীয় গাইড আপনাকে নাফাখুম নিয়ে যাবে। আর সময় থাকলে সরাসরি চলে যেতে পারেন নাফাখুম।

রেমাক্রি খাল ধরে পায়ে হেঁটে নাফাখুম পৌঁছাতে ২ থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে। তবে সবার হাঁটার শক্তি ভালো থাকলে আরো কম সময় লাগবে। মাঝে মাঝে খাল ২-৩ বার এপার ওপার করতে হবে। খালে কখনো হাটু পানি, কখনো কোমর পানি, তবে তীব্র স্রোত থাকে। ২-৩ জায়গা ছাড়া বাকি পথ মোটামোটি ভালোই।

নাফাখুমে কিছুক্ষন থেকে ছবি তুলে আবার রওনা দিবেন থুইসাপাড়ার দিকে। নাফাখুম থেকে ৩/৪ ঘন্টা ট্রেকিং করেই পৌঁছে যাবেন থুইসাপাড়া। থুইসাপাড়া যেতে বেশি সময় লাগলে এর আগের পাড়া জিনাপাড়ায় রাত কাটাতে পারেন।

থুইসাপাড়া থেকে আমিয়াখুম

থুইসাপাড়া রাতে থেকে পরের দিন সকালে আরো একজন গাইড নিয়ে রওনা দিবেন দেবতা পাহাড় হয়ে অমিয়াখুমের উদ্দেশ্যে। গাইড ভাড়া ৫০০ টাকা। থুইসাপাড়া থেকে আমিয়াখুম যাওয়ার পথ দুটো। একটা ঝিরি পথ + পাহাড়ি পথ। আরেকটা শুধু পাহাড়ি পথ। যাওয়ার সময় পাহাড়ি পথ ও আসার সময় ঝিরি পথ ব্যবহার করতে পারেন।

শুধু পাহাড়ি পথে ৩০ মিনিট ট্রেকিং করার পর প্রথম পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাবেন। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা দিবেন। ৩০ মিনিট ট্রেকিং করার পর দ্বিতীয় পাহাড়ে পৌঁছাবেন। এর নাম নিকোলাস পাহাড়। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এখানে কিছু পরিবার থাকে। পাড়ার নাম নিকোলাস পাড়া। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার ট্রেকিং শুরু করবেন।

কিছুক্ষন পর পৌছে যাবেন দেবতা পাহাড়ের চূড়ায়। দেবতা পাহাড় থেকে নামাটা বেশ কষ্টকর এবং বিপদজনক। তাই সাবধান থাকবেন। অনেক সময় ৮০/৯০ ডিগ্রি খাড়া ভাবে নামতে হয়। নিচে নামতে প্রায় ১ ঘন্টার মতো সময় লাগাতে পারে। নিচে নেমে ডানের রাস্তা চলে গেছে ভেলাখুম ও নাইক্ষংমুখে এবং বামের রাস্তা চলে গেছে আমিয়াখুম ও সাতভাইখুমের দিকে।

দেবতা পাহাড় থেকে নেমে ২/৩ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন আমিয়াখুম। থুইসাপাড়া থেকে এখানে আসতে ৩ ঘন্টার মতো সময় লাগবে। তবে টিমের স্টেমিনার উপর নির্ভর করে সময় আরো কিছু কম বেশি লাগতে পারে।

আমিয়াখুমের পাশের রয়েছে ভেলাখুম এবং সাতভাইখুম জলপ্রপাত। তাই আপনার ট্রাভেল প্ল্যান সেভাবেই সেট করুন। ফিরতি পথে থুইসা পাড়ায় রাত কাটিয়ে আবার একই পথে বা ভিন্ন পথে থানচি ফেরত আসুন। থানচি থেকে বান্দরবান এসে ফিরে চলে যান আপনার গন্তব্যে।

আমিয়াখুম এ কোথায় থাকবেন

থানচি, রেমাক্রি পর থাকার জন্য আর তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা নাই। আদিবাসীদের ঘরই একমাত্র ভরসা। আদিবাসীদের ঘরে পর্যটকদের থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে। সব ব্যাপারে গাইড আপনাকে সাহায্য করবে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে পরবে রেমাক্রি, নাফাখুম পাড়া, জিনাপাড়া, থুইসাপাড়া। সাধারণত এই পাড়া গুলোতেই সবাই রাত্রি যাপন করে। আর এগুলো নিরাপদ।

কোথায় খাবেন

থানচির পর এই লম্বা যাত্রা পথে আদিবাসীদের ঘরেই আপনাকে খাবার খেতে হবে। আদিবাসীদের ঘরে পর্যটকদের জন্য খাবারের ভালো ব্যবস্থা আছে। ভাত, সবজি, ডাল, আলু ভর্তা, মুরগির মাংস ইত্যাদি মেনু তে থাকে। কি খাবেন তা গাইড কে বলে রাখলে উনি সব ব্যবস্থা করে রাখবেন। তবে সাথে হালকা শুকনা খাবার যেমন, খেজুর, বিস্কুট, চকলেট চিড়া, মুড়ি, ফল ইত্যাদি নিয়ে যেতে পারেন।

এছাড়া বিভিন্ন পাড়ায় কিছু মুদি দোকান পাবেন। সেখানে কোক, বিস্কুট, মিনারেল পানি ইত্যাদি পাওয়া যায়। পাহাড়ি ফল পাওয়া যায়। খেতে পারেন। পুরো যাত্রা পথে আপনাকে কঠিক পরিশ্রমের ট্রেকিং করতে হবে। তাই শরীরে এনার্জি দরকার আছে।

ভ্রমণ টিপস এবং সতর্কতা

খরচ কমাতে চাইলে ছুটির দিন পরিহার করুন এবং দলগত ভাবে ভ্রমণ করুন। ট্রেকিং এর জন্য ভালো গ্রিপের জুতা নিবেন। সাঁতার না জানলে এবং বর্ষাকালে গেলে লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখুন। পাথুরে পথ অনেক পিচ্ছিল, তাই সাবধানে হাঁটবেন। থানচির পর বিদ্যুৎ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই। তাই মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক চার্জ দিয়ে রাখুন।

কেবল কাঁধের ব্যাগ সাথে নিবেন এবং ব্যাগের ওজন যত কম হয় সেই দিকে খেয়াল রাখুন। প্যারাসিটামল, গ্যাসের ঔষধ, স্যালাইন ইত্যাদি দরকারি ঔষধ সাথে রাখুন। দল ছাড়া একা কোথাও যাবেন না। দলের বাকি সদস্যদের খেয়াল রাখুন। একজনের বিপদে এগিয়ে আসুন। আদিবাসীদের সাথে ভালো আচরণ করুন।

3.8 13 ভোট
রেটিং

লেখক

Rashedul Alam; Rasadul Alam; founder of cybarlab.com; founder of trippainter.com; trippainter.com; cybarlab.com; Bangladeshi travel blogger; Bangladeshi blogger; Bangladeshi software engineer

আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।

Subscribe
Notify of
2 মন্তব্য
Inline Feedbacks
সব মন্তব্য দেখুন

''

2
0
আমরা আপনার অভিমত আশা করি, দয়াকরে মন্তব্য করুনx