ভুটান ভ্রমণ কাহিনী

থিম্পু ফুন্টশোলিং হাইওয়ে ধরে দেশে ফেরা | ভুটান ভ্রমণ -পর্ব ৭

Loading

থিম্পু ফুন্টশোলিং
পাহাড়ি ঝর্ণা, থিম্পু ফুন্টশোলিং হাইওয়ে: নভেম্বর ২৬, সকাল ১০:৪০

পাঁচ দিন যাবত আমরা ভুটানে অবস্থান করছি। এই কয়দিনে ভুটানের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি সবাই এর প্রেমে পরে গেছি। ভুটান দেশটা আসলেই অনেক সুন্দর, পরিপাটি। নিজ চোঁখে না দেখে এর সৌন্দর্য বর্ণনা করা মুশকিল। এই জন্যই সবাই একে বলে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড। প্রতিদিনই আমরা খুব দৌড়ের উপর ছিলাম, তাই সবাই বেশ ক্লান্ত। থিম্পু ফুন্টশোলিং হাইওয়ে ধরে এবার দেশে ফেরার পালা।

পারো টু ফুন্টশোলিং

নভেম্বর ২৬, ২০১৭ পারো। ভুটানে আজ আমাদের শেষ দিন। আজ আমরা ভুটান ছেড়ে ভারতের শিলিগুঁড়ি শহরে চলে যাব। খুব সকালেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। বেশ ঠান্ডা, তাপমাত্রা প্রায় ০ ডিগ্রি। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি অবস্থা করুন। কুয়াশার জন্য কিহুই দেখা যাচ্ছেনা। আরো কিছুক্ষন শুয়ে থেকে সবাই কে ডেকে তুলি রেডি হবার জন্য।

বাথরুমে গিয়ে দেখি গ্রিজার কাজ করছেনা। পানি সেই ঠান্ডা, তাই আর গোসল করলাম না। শহীদ ভাই তাও সাহস করে গোসলের জন্য এগিয়ে যায়। প্রথম বার শরীরে পানি লাগতেই সেই জুড়ে চিৎকার করে উঠে। তার চিৎকারে সবাই ভয় পেয়ে যাই। যারা তখনো ঘুম থেকে উঠে নাই তারাও উঠে পরে। যাই হোক ওনার তেমন কিছু হয় নাই। সবাই তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে আসি। এসে দেখি গাড়ি রেডি। যাবার পথে কোন এক জায়গার আমরা নাস্তা করে নিব।

বাসায় কথা না বলার বিড়ম্বনা

রাতে বিদ্যুৎ না আসায় বাসায় আর কথা বলতে পারি নাই। হোটেলের নিচে এসে তাড়াতাড়ি ওয়াইফাই কানেক্ট করে বাসায় কল করে দেখি সেই গেড়াকল লেগে গেছে। আমাদের সবার পরিবারের লোকজন একে অন্যের সাথে কনেক্টেড। দুপুর থেকে কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা। বাসার লোকজন ভেবেছে আমরা নিশ্চই কোনো বিপদে পড়েছি।

দুঃশ্চিন্তায় কেউ রাতে ঘুমাতে পারে নাই। তারা অফিসে যোগাযোগ করেও কোনো নিউজ না পেয়ে হতাশ হয়ে যায়। অফিস থেকেও আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। আমাদের খোঁজ নেবার জন্য তারা ভুটানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও যোগাযোগ করে। বেপারটা এতদূর গড়াবে আমরা বুজতে পারিনাই। যাই হোক এমন হলে আপনারা হোটেল বা ড্রাইভার এর মোবাইল থেকে দেশে ১ মিনিট কথা বলে নিবেন।

থিম্পু ফুন্টশোলিং হাইওয়েতে পথচলা

আবার সেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। উদ্দেশ্য ভুটানের ফুন্টশোলিং বর্ডার। সেখান থেকে ভারতের হাসিমারা রেলস্টেশন। ভারতে ট্রেন ভ্রমণ অন্যরকম। তাই আমরা সিদ্দান্ত নেই হাসিমারা থেকে ট্রেনে করে শিলিগুঁড়ি যাব। শিলিগুঁড়িতে কিছু শপিং করব, মুভি দেখব।

শিলিগুঁড়ি থেকে পরের দিন ৩ টায় আমাদের বাস ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবে। আপনারা চাইলে শিলিগুঁড়ি ১ রাত থাকতে পারেন। আর না হলে ফুন্টশোলিং থেকে সোজা ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার চলে যাবেন। বর্ডারের কাজ শেষে বাংলাদেশের বুড়িমারী থেকে বাসে ঢাকায় চলে যাবেন। চ্যাংড়াবান্ধা-বুড়িমারী বর্ডার ৬:৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে। তাই সেভাবেই আপনার প্ল্যান সেট করবেন।

ঘন্টা দুই পরে আমরা থিম্পু-ফুন্টশোলিং হাইওয়ে এর পাশে এক রেস্টুরেন্টে নামি সকালের নাস্তা করার জন্য। রেস্টুরেন্ট এর ভিউ খুবই সুন্দর। মূল সড়ক থেকে একটু উপরে পাহাড়ের উপর চমৎকার এক রেস্টুরেন্ট। এখানে ভুটানি খাবার, ব্রেড, বিস্কুট, চকলেট, চা, কফি, পানীয় ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়।

রেস্টুরেন্ট এর ভিতরে দেখি গা গরম করার জন্য এক ধরণের চুলা ঘুড়তাছে। আমরা সেখানে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে শরীর গরম করে নেই। খাবারে কি মারাত্মক ঘন্ধরে বাবা। পাশেই শুকর বাধা রয়েছে। সেখানে শুকরের মাংস খাওয়া নরমাল ব্যাপার। এইসব দেখে অন্য কিছু খাওয়ার ইচ্ছা চলে যায়। তাই আমরা ব্রেড, বিস্কিট আর চা খেলাম। নাস্তা শেষ করে আমরা আবারো এগিয়ে চললাম।

থিম্পু ফুন্টশোলিং হাইওয়ে এর সৌন্দর্য

থিম্পু-ফুন্টশোলিং হাইওয়ে ভুটানের সব থেকে ব্যস্ততম হাইওয়ে। এটাই তাদের মালামাল পরিবহনের প্রধান সড়ক। তাই এখানে গাড়ির পরিমান একটু বেশি। অন্যদের থেকে এটি তুলনামূলক ভাবে প্রশস্ত। এর আশেপাশের সৌন্দর্য খুবই চমৎকার। বড় বড় পাহাড় কেটে বানানো সড়কটি কখনো অনেক উপরে উঠে গেছে আবার একটু পরেই নিচে নেমে গেছে। আমরা পাহাড়ের উপর থেকে অনেক দূরে ছোট ছোট গাড়ি দেখতে পাই। আবার একটু পরেই দেখি আমরা সেখানে আছি।

কিছুক্ষন পর পর চোখে পড়ছে পাহাড়ি ঝর্ণা। আমরা তেমন একটি পাহাড়ি ঝর্ণা দেখে নেমে পারি। ঝর্ণাটি অনেক বড়। অনেক উপর থেকে পানি বিশাল বিশাল পাথর ভেদ করে তীব্র গতিতে নিচে নেমে আসছে। পানির সে কি গর্জন। ঝর্ণার পানি অনেক ঠান্ডা আর পরিষ্কার। আমরা সেখানে কিছু সময় পার করে আবার চলা শুরু করি।

রাস্তায় বানরের পাল

কিছুক্ষন পর দেখি অল্প কিছু বানর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছে। আমরা সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে যাই। জানালা খুলে আমি সাথে থাকা চিপস তাদের খাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেই। সুন্দর ভাবে এসে নিয়ে খেয়ে ফেললো। আমরা আরো দিতে থাকি। একটু পর দেখি কয়েক হাজার বানর চলে আসছে!! এত বানর একসাথে আগে কখনো দেখি নাই। তাও আবার সবাই উন্মুক্ত ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের সাথে চিপস, কলা, খাবার যা ছিল ওদের দিয়ে দেই। এমন দৃশ্য দেখবো আগে কখনো ভাবিনাই। সত্যিই তা ছিল অপূর্ব।

সামনে এগিয়ে দেখি হরিণ রাস্তার পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা গাড়ি থামিয়ে তাদের ছবি তুলার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ওরা চলে যায়। ভুটানে এসে বন্য প্রাণীদের এভাবে উন্মুক্ত ভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে সত্যিও খুব ভাল লাগল। গভীর বনে নাকি বাঘ ও থাকে।

থিম্পু ফুন্টশোলিং
বন্য হরিণ, থিম্পু-ফুন্টশোলিং হাইওয়ে: নভেম্বর ২৬, সকাল ১১:২৪

মেঘের ভিতর দিয়ে চলা

আমরা আবারো এগিয়ে চলি। কিছুক্ষন পর সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল। আমরা পুরাপুরি মেঘের ভিতরে চলে এসেছি। তাড়াতাড়ি সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ি আর মেঘের ভিতর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করি। সেই এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। সাজ্যেকে আমরা অনেকেই হয়তো মেঘ দেখেছি, কিন্তু এখানকারটা অন্যরকম।

থিম্পু ফুন্টশোলিং

পাশেই দেখি লেখা মেঘ প্রবন এলাকা, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সাবধান!! আমরা গাড়ি নিয়ে আস্তে আস্তে আবার সামনে এগিয়ে চলি। আমি জানালা খুলে হাত বের করে রাখি। মেঘে আমার হাত ভিজে যাচ্ছিল। ঠান্ডায় পুরা হাত অবস হয়ে যাবার মতো অবস্থা।

ইমিগ্রেশন

দুপুর ১ টার দিকে আমরা চলে আসি ফুন্টশোলিং। ভুটান গেটের পাশেই অবস্থিত ইমিগ্রেশন অফিস থেকে পাসপোর্টে এক্সিট সিল মেরে নেই। পরে ফুন্টশোলিং এ কিছু কেনাকাটা করি নিজেদের কাছে থাকা ভুটানের মুদ্রা গুলট্রাম সব শেষ করার জন্য। আপনারা আপনাদের সাথে যত গুলট্রাম আছে সব ভুটান থাকতেই শেষ করে দিবেন। পরে এগুলা আর কোথাও কনভার্ট করতে পারবেন না। আর পারলেও অনেক ঝামেলা হবে, তেমন দাম পাবেন না।

তার পর একই গাড়িতে চলে আসি ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে। সেখান থেকে পাসপোর্টে পুনরায় এনট্রি সিল নিয়ে নেই।

বিশেষ সতর্কতা

ইন্ডিয়া – ভুটান বর্ডার এক আজব বর্ডার। এখানে ঢুকতে বা বের হতে কোনো চেকিং নাই। কেউ আপনাকে কিছুই জিজ্ঞেস করবেনা। আপনার পাসপোর্ট, ভিসা আছে কিনা কেউ দেখবেনা।

তাই এখানে একটু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। আপনাকে নিজে যেয়েই নিজের পাসপোর্টে ভুটান থেকে বের হবার জন্য এক্সিট সিল আর ভুটানে প্রবেশ করার জন্য এন্ট্রি সিলে নিয়ে নিতে হবে। ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিস থেকেও ইন্ডিয়া থেকে বের হবার জন্য এক্সিট সিল আর ইন্ডিয়াতে প্রবেশ করার জন্য এন্ট্রি সিলে নিয়ে নিতে হবে।

নাহলে পরে অনেক সমস্যা হবে। আপনাকে চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তে আটকে দিবে। বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিবেনা। অনেকেই এই ভুল করে, আর পরে পুনরায় জয়গাঁ এসে সিল নিয়ে যায়।

অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:

সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।

5 1 ভোট
রেটিং

লেখক

Rashedul Alam; Rasadul Alam; founder of cybarlab.com; founder of trippainter.com; trippainter.com; cybarlab.com; Bangladeshi travel blogger; Bangladeshi blogger; Bangladeshi software engineer

আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।

Subscribe
Notify of
3 মন্তব্য
Inline Feedbacks
সব মন্তব্য দেখুন

''

3
0
আমরা আপনার অভিমত আশা করি, দয়াকরে মন্তব্য করুনx