ভুটান (Bhutan) দক্ষিণ এশিয়ার এক ক্ষুদ্র দেশ। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। সুবিশাল হিমালয়ের কল্যাণে উঁচু উঁচু পাহাড়, ঘন জঙ্গল, সবুজ ভ্যালি ভুটানকে করেছে অপরূপ। ফ্রেন্ডস ট্যুর, ফ্যামিলি ট্যুর, মধুচন্দ্রিমা, কাপল ট্যুর, সবকিছুর জন্যই ভুটান হতে পারে আপনার প্রথম পছন্দ। কারণ যেকোনো ধরনের, যেকোনো বয়সের মানুষ এর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতে বাধ্য। আজ আমি সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ করে এসে এর এর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করব।
ভুটান কিভাবে যাবেন
বিভিন্ন ব্লগ পরে এবং ইউটিবে ভিডিও দেখে আমিও ভুটানের প্রেমে পরে যাই এবং সিদ্ধান্ত নেই এবার ভুটান যাব। যেকোনো ট্যুরেই একা থেকে দলবদ্ধ ভাবে গেলে অনেক বেশি মজা হয়, আর খরচ ও কমে যায়। দল বা টিমের সাইজ ৪ বা ৬ গুণিতক হলে ভাল। তাহলে নিরাপত্তা নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করা লাগেনা এবং হোটেল বুকিং, গাড়ি ভাড়া করতে সুবিধা হয়।
আমিও টিম খুঁজতে থাকি এবং আমার অফিসের ৭ জন কে পেয়ে যাই। যেই কথা সেই কাজ, আমার অফিসের সাত কলিগ মিলে ভুটান ভ্রমণের প্লানিং শুরু করে দেই। ভুটান বাংলাদেশিদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসা প্রদান করে। মানে আপনে ভুটান গেলেই ওরা আপনাকে ভিসা দিবে। তাই আগে থেকে ভিসার জামেলা নাই।
ভুটানে আকাশ পথে মানে প্লেনে এবং সড়ক পথে দুই ভাবেই যাওয়া যায়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ করবো। বাংলাদেশের সাথে ভুটানের সরাসরি কোনো বর্ডার নাই, তাই ভারত হয়েই আমাদের ভুটান যেতে হবে। ঢাকা থেকে বুড়িমারী/চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়া ভারতে প্রবেশ করে ওইখান থেকে বাস বা ট্যাক্সি করে ভুটান বর্ডার জয়গাঁ/ফুন্টশোলিং দিয়ে ভুটানে প্রবেশ করা যায়। (চ্যাংড়াবান্ধা, জয়গাঁ – ভারতে)
ভুটান ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাস ভুটানে বেড়ানোর সব থেকে ভাল সময়। কারণ এই সময় আবহাওয়া খুব ভালো থাকে। এই সময়ে ভুটানে পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে। শীতকালে ভুটানে মারাত্বক ঠান্ডা পরে এবং বরফ জমে অনেক রাস্তা ঘাট বন্ধ হয়ে যায়। তাই শীতকাল ভুটানে বেড়ানোর ভাল সময় নয়। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে এ সময়টাও ভুটানে বেড়ানো কঠিন। আমরা যেহেতু বরফ দেখতে চাই তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা নভেম্বরে যাব। তখন শীত একটু কম থাকে। আমরা ২০১৭ সালের ২১ শে নভেম্বর ঢাকা থেকে সড়ক পথে ভুটানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি এবং ২০১৭ সালের ২৮ শে নভেম্বর ঢাকায় ফিরে আসি।
সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ করতে কেমন সময় লাগে
ভুটানে মোট ২০ টা ডিস্ট্রিক্ট রয়েছে। সব গুলাতেই রয়েছে বেশ কিছু ছোট বড় শহর আর দর্শনীয় স্থান, যার সবগুলাই অসম্ভব সুন্দর। সব ভ্রমণ করতে মোটামোটি এক মাস লেগে যাবে। যাদের প্রচুর টাকা পয়সা রয়েছে এবং হাতে আছে যথেষ্ট সময় তারাই কেবল এমন অভিযানে নামতে পারে। আমাদের ড্রাইভার জানালো সে ভারতীয় এক দম্পতিকে একবার এমন অভিযানে নিয়ে গিয়েছিল।
তবে থিম্পু, পারো, ফুন্টসলিং, পুনাখা, বুমথং এবং হা ভ্যালি এই শহর গুলি ঘুরলেই মোটামোটি ভুটান ভ্রমণ হয়ে যাবে। আর এর জন্য প্রয়োজন প্রায় ৭-৮ দিন। আমরা থিম্পু, পারো, পুনাখা এবং ফুন্টসলিং শহর এবং এর আশে পাশের দর্শনীয় স্থান গুলো ভ্রমণ করি। সময় লাগে এক সপ্তাহ। এইজন্য অবশ্যই আমি আমার অফিস রেইডলাইম সলিউশনস কে ধন্যবাদ দিব আমাদের এই লম্বা ছুটি এবং অন্য সব আনুসঙ্গিক সহযোগিতা করার জন্য। তবে সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ না করে আকাশ পথে গেলে, সময় আরো ২ দিন কম লাগতে পারে।
সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ এর খরচ
একজন মানুষ মাত্র ১৫০০০ টাকায় সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ করে আসতে পারে। তবে অনেকের খরচ একটু কম বেশি হতে পারে। কারণ বিভিন্ন দামের হোটেল, খাবার রয়েছে। আপনে কোথায় থাকবেন কি খাবেন তা নিতানন্তই আপনার ব্যপার। আমরা ফিরার পথে একরাত ভারতের শিলিগুঁড়ি তে ছিলাম। শপিং ছাড়া আমাদের একেক জনের ১৫০০০ টাকার মতো খরচ হয়।
শ্যামলি পরিবহন বাসের শিলিগুড়ি-ঢাকা আসা-যাওয়া টিকেট ৩০০০ টাকা, ঢাকা-বুড়িমারী ৮০০-১০০০ টাকা (অন্য বাসে), ইন্ডিয়ান ভিসা প্রসেসিং ফি ৬০০ টাকা, ডলার এন্ড্রোসমেন্ট ফি ১৩০-৫০০ টাকা (ব্যাংক ভেদে), ট্র্যাভেল ট্যাক্স (বাংলাদেশ সরকার) ৫০০ টাকা, বর্ডারে বকশিস ১০০/২০০ করে ৩০০/৪০০ টাকা (আসা-যাওয়া)। ট্র্যাভেল ট্যাক্স সোনালী ব্যাংক থেকে কেটে নিতে পারেন যাবার আগে। অথবা বর্ডার থেকেও করতে পারেন। ওরা ৫০-১০০ টাকা চার্জ নিবে। বাকি টাকা ভুটানে গাড়ি ভাড়া, হোটেল খরচ এবং খাবার খেতে খরচ হয়।
কিভাবে পাবেন ইন্ডিয়ান ভিসা
সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণের জন্য প্রথমেই আমাদের প্রয়োজন ভারতীয় ট্রানজিট ভিসার, যা কিনা ঢাকার গুলশান (এখন অন্যান্য শাখাতেও পাওয়া যায়, যেমন চট্টগ্রাম) শাখা থেকে নেয়া যায়। বাসের টিকেট কাটতে হবে। বাসের টিকেট ট্রানজিট ভিসার কাগজ পত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। শ্যামলী পরিবহন ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যায়। আমরা শ্যামলী পরিবহনের টিকেট কাটি। আপনি চাইলে অন্য বাসের টিকিট ও কাটতে পারেন। কিভাবে ইন্ডিয়ান ট্রানসিট ভিসার আবেদন করতে হয় তা এখানে দেয়া আছে। দেখে নিতে পারেন।
আমরা সাতজন ভিসার জন্য আবেদন করি। প্রদানের নির্ধারিত দিনেও ইন্ডিয়ান হাইকমিশন আমাদের পাসপোর্ট ফেরত না দেয়ায় সবাই ভিশন টেনশনে পরে যাই। ভিসা পাব কি পাবনা, এইদিকে আমাদের যাবার তারিখ ও চলে আসছে। যাই হোক সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে যাবার আগের দিন আমরা ছয় জন ভিসা পেয়ে যাই। দূর্ভাগ্যবসত এক জন ভিসা পায় নাই। ওনার পাসপোর্ট এ ঝামেলা ছিল। মনে রাখবেন ট্রানসিট ভিসা ভ্রমণ করার ২-১ দিন আগে দেয়। তাই ঘাবড়ানোর কিছু নাই।
সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ এর প্ল্যানিং
ভুটানে আপনে কোথায় কোথায় ঘুরবেন, কখন কোথায় থাকবেন তার একটা খসড়া ঢাকা থেকেই করে নিবেন। আমরা প্ল্যান করি নভেম্বরের ২১ তারিখ রাতে ঢাকা থেকে রওনা করে ২২ তারিখ সকালে ভারতে প্রবেশ করব। সেখান থেকে বাসে জয়গাঁ হয়ে ভুটানের ফুন্টশোলিং এ প্রবেশ করব। ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু এবং পারোর পারমিশন নিয়ে থিম্পুতে চলে যাব। ২২ তারিখ রাত থিম্পুতে থেকে ২৩ তারিখ দিনে থিম্পু শহর ভ্রমণ করব এবং পুনাখা যাবার পারমিশন নিব।
২৪ তারিখ সকালে আমার পুনাখা যাব। যাবার পথে দোচুলা পাস দেখব। পুনাখা শহর ঘুরে পুনরায় থিম্পুতে চলে আসব। থিম্পু থেকে ২৫ তারিখ সকালে হোটেলে চেকআউট করে পারোর পথে যাত্রা করব। প্রথমে চেলালা পাস যাব, তার পরে টাইগার নেস্টে উঠব। রাতে পারো থেকে ২৬ তারিখ সকালে দেশের পথে রওনা দিয়ে রাতে ভারতের শিলিগুঁড়ি তে থাকব। সেখান থেকে ২৭ তারিখ বিকালে দেশে ফেরার জন্য শ্যামলী পরিবহনের বাসে উঠব। ২৮ তারিখ সকালে আমরা ঢাকায় পোঁছাব। সংক্ষেপে আমাদের ট্যুর প্ল্যান:
প্রথম দিন:
ঢাকা থেকে থিম্পর উদ্দেশে যাত্রা
দ্বিতীয় দিন:
থিম্পু শহর ভ্রমণ এবং পুনাখা যাবার পারমিশন সংগ্রহ করা
তৃতীয় দিন:
দোচুলা পাস দেখা, পুনাখা শহর ভ্রমণ এবং পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ দেখা
চতুর্থ দিন:
চেলে লা পাস দেখা, পারো শহরে ঘুরাঘুরি এবং টাইগার নেস্ট দেখা
পঞ্চম দিন:
পারো থেকে ভারতের শিলিগুঁড়ি শহরের উদ্দেশে যাত্রা
ষষ্ঠ দিন:
শিলিগুঁড়ি শহর ভ্রমণ এবং কেনাকাটা
সপ্তম দিন:
শিলিগুঁড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা
এবার মূল ভ্রমণে আসি
২০১৭ সালে ২১ শে নভেম্বরে রাত ৯ টায় আমরা ঢাকার কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী পরিবহনের বাসে উঠি। সারা পথই আমরা গল্পগুজব করতেছিলাম আর অতিরিক্ত উত্তেজনায় কারোরই ঘুম আসছিলনা। তবে আপনারা পারলে একটু ঘুমিয়ে নিবেন। কারণ পরদিন অনেক ধকল যাবে। সকাল সাতটায় আমরা বুড়িমারী বর্ডারে চলে আসি। কিন্তু বর্ডারের কাজকর্ম শুরু হয় সকাল ৯ টা থেকে।
তাই এই সময় একটু ফ্রেস হয়ে নাস্তা করার জন্য চলে যাই বুড়ির হোটেলে। এইখানে ভাত, রুটি দুইটাই পাওয়া যায়। আমরা গরম ভাত, আলু ভর্তা, দেশি মুরগির মাংস খাই। একটু ঝাল তবে টেস্টি। আপনারাও তাই করতে পারেন। কারণ আগামী কয়েকদিন তৃপ্তি করে আর কিছু খেতে পারবেন না। যা খাবেন সব গন্ধযুক্ত খাবার। খেলে অনেকেরই বমি চলে আসতে পারে। বাকি সময় আমরা ছবি তুলে, বাস কাউন্টারে বসেই কাটাই। আপনারা চাইলে মোবাইল, পাওয়ার ব্যাঙ্ক চার্জ করে নিতে পারেন।
বুড়িমারী ইমিগ্রেশন অফিস
৯ টায় চলে যাই ইমিগ্রেশন অফিস। ভ্যান ওলারা তাদের ভ্যানে উঠতে বলবে, দরকার নাই আপনে হেঁটেই চলে যাবেন। বর্ডারে দুই পাশেই প্রচুর দালাল রয়েছে, তারা আপনাকে ভয় দেখাবে, কাজ করে দিতে চাইবে। দরকার নাই আপনে নিজেই নিজের কাজ করার চেষ্টা করবেন। সব খুবই সহজ। আমরা অবশ্য শ্যামলী বাসের সুপারভাইজারকে ১০০ টাকা করে দেই। সেই সব কাজ দ্রুত করে দেয়। আপনে শ্যামলী বাসে গেলে একই কাজ করতে পারেন।
কাস্টমস এর লোকজন সাথে টাকা আছেকিনা জিজ্ঞাসা করলে বলবেন নাই। আপনে আপনার টাকা পয়সা সব এমন জাগায় লুকায় ফেলেন যাতে তারা খুঁজেও না পায়। সব কাজ শেষ করে হেটে হেটে প্রবেশ করি ভারতের মাটিতে। তখন দেশের জন্য একটু মায়া লাগতেছিলো। আপনে হয়তো প্লেনে নিজ থেকে অন্য দেশে গেছেন কিন্তু কেবল স্থল পথে অন্য দেশে গেলেই দেশের জন্য অন্নরক একটা এ ফিলিংস হবে।
চেংড়াবান্দা ইমিগ্রেশন অফিস
চেংড়াবান্দা ইমিগ্রেশন অফিসের কাজ শেষ হতে তেমন সময় লাগেনা। এরা বেশ দ্রুতই কাজ করে এবং বন্ধুসুলভ। ইমিগ্রেশেনের কাজ শেষ করে চলে যাই টাকা কে রুপিতে কনভার্ট করতে। এখানে অনেক মানি এক্সচেঞ্জ এর দোকান রয়েছে। দরদাম করে যে ভাল রেট দিবে তার কাছেই টাকা কনভার্ট করবেন। আমরা শ্যামলী পরিবহনের যে মানি এক্সচেঞ্জের দোকান রয়েছে ওই খান থেকেই টাকা কনভার্ট করি। এরা ভালো রেট দেয়। এক্সচেঞ্জের এর রশিদ নিয়ে নিবেন, পরে দরকার হতে পারে।
চেংড়াবান্দা থেকে বাস এবং ট্যাক্সি দুই ভাবেই জয়গাঁও যাওয়া যায়। বাসে গেলে ১০০ রুপি, আর ট্যাক্সি তে সাইজ ভেদে ১০০০ থেকে ২০০০ রুপি নিবে। ট্যাক্সি নিলে দরদাম করে নিবেন। আমাদের টিকিট যেহেতু শিলিগুড়ি পর্যন্ত তাই পাশেই অপেক্ষমান শ্যামলী পরিবহনের বাসে উঠে পড়ি।
চ্যাংড়াবান্ধা থেকে জয়গাঁ
বাস ছাড়ার সাথে সাথেই আমরা ড্রাইভার কে বলে রাখি আমরা ময়নাগুড়ি বাইপাস নামবো। ২০-২৫ মিনিটেই চলে আসি ময়নাগুড়ি। সেখানে নেমে এই প্রথম নিজেকে অসুরক্ষিত মনে হতে লাগলো। ভিন দেশ, ভিন্ন এলাকা, অন্নরকম মানুষ। যাই হোক সাহস করে একজন কে জিজ্ঞাসা করি, হাসিমারা যাবার বাস কোথায় থামে? উনি দেখায় দিলো, রাস্তার অন্য পাশে। একটা কথা বলে রাখি এখানকার লোকজন বাংলা, হিন্দি দুইটাতেই কথা বলে। তবে বাংলা একটু বেশিই বলে।
২০-২৫ মিনিট পরেই বাস চলে আসে। আমরা সবাই বাসে উঠে বসি। বাসে একটা জিনিস লক্ষ করলাম, বাসের কন্ডাক্টর পেন্ট শার্ট পরিহিত পড়ি পাটি, যেমনটা আমাদের দেশে দেখা যায় না। ভারতের রাস্তাগুলা অনেক চওড়া এবং ভালো। প্রায় দুই ঘন্টা পর আমরা চলে আসি হাসিমারা। ও আচ্ছা ময়নাগুড়ি থেকে হাসিমারা বাস ভাড়া ৫০ রুপি।
হাসিমারা থেকে টেম্পু তে করে চলে আসি জয়গাঁও, সময় নিলো ১০ -১৫ মিনিটের মতো। হাসিমারা – জয়গাঁও রাস্তাটা অনেক সুন্দর, দুই পাশে বিশাল বিশাল চা বাগান। এতো বিশাল এলাকা নিয়ে চা বাগান আগে দেখিনাই। টেম্পুর ড্রাইভার আমাদের কে জয়গাঁও ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসের গেটেই নামিয়ে দেয়। হেটে ভিতরে প্রবেশ করি, এক্সিট সীল নিয়ে পায়ে হেটে চলে আসি ভুটান গেইট।
ভুটানে প্রবেশ
জয়গাঁও ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে ভুটান গেইট দিয়ে পায়ে হেটে ভুটানের ফুন্টশোলিং শহরে প্রবেশ করি। গেইট কোনো চেকিং নাই, কোনো ফি নাই, মানুষ যে যার মতো প্রবেশ করছে আবার বের হচ্ছে। মনেই হচ্ছেনা এটা দুই দেশের বর্ডার। শহরে প্রবেশ করতেই আমাদের মন আশ্চর্য রকম ভালো হয়ে যায়। ঝকঝকে শহর, রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা নেই, গাড়ির হর্ন নেই। কত সুন্দর!
ফুন্টশোলিং ইমিগ্রেশন অফিস
ভুটান ইমিগ্রেশন অফিস ফুন্টশোলিং এ অবস্থিত, জাস্ট ভুটান গেইটের পাশে। এখান থেকে আমরা অন অ্যারাইভাল ভিসা নেই। এখানে ভিসা ফর্ম পুরণ করতে হবে, সাথে এক কপি ছবি, পাসপোর্টের কপি দেয়া লাগে। ভালো কথা সাথে বাংলাদেশ থেকে লেখার জন্য কলম নিয়ে আসলে ভালো হয়। এখান থাকে শুধু থিম্পু আর পারো শহর ভিসিট করার অনুমতি পাওয়া যায়। পুনাখা, হ্যাঁ ভ্যালী, বুমথাং ও অনন্য জায়গার অনুমতি পরে থিম্পু থেকে নিতে হবে।
মনে রাখবেন ফুন্টশোলিং ইমিগ্রেশন অফিস শুধু মাত্র বাংলাদেশি আর বিদেশি (Europe/American etc) দের জন্য সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে, কোনো সরকারি বন্ধ নেই। বাংলাদেশিদের ভুটানিরা খুব সম্মান করে। ভুটান খুব পরিপাটি দেশ, তাই যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না, সিগারেট খাবেন না, তাহলে জরিমানা করবে। জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হবেন না। ক্রসিং এ দাঁড়ালে গাড়ি আপনা আপনি থেমে যাবে।
ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু
ফুন্টশোলিং থেকে ভিসা নিয়ে থিম্পু যাবার জন্য আমরা ছয় সিটের একটি জিপ গাড়ি ভাড়া করি। ভাড়া নিল ৩৩০০ রুপি। দরদাম করে গাড়ি ভাড়া করবেন এবং ড্রাইভার ভালো ইংরেজী বা হিন্দি বুঝেকিনা জিজ্ঞেস করে নিবেন। ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পুর দুরুত্ব প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু বাসেও যাওয়া যায়। শেষ বাসের সময় বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট, ভাড়া ২৪০ রুপি, সময় লাগবে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা।
তবে আমার মতে ট্যাক্সি তে যাওয়াই ভাল, তাহলে কোনো জায়গা ভাল লাগলে নেমে ছবি তুলা যাবে। আপনে পরবর্তীতে যে কয়দিন ভুটানে থাকবেন তার গাড়িটি ব্যবহার করতে পারেন। ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু যাবার পথে পরবে গেদু, চুখা, বুনাখা, চাপচা শহর। এগুলা অনেক ছোট কিন্তু সুন্দর।
ফুন্টশোলিং এ একটু ঘুরাঘুরি করে, হালকা কিছু নাস্তা করে প্রায় সন্ধ্যার আগ দিয়ে আমরা থিম্পুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ভুটানে তেমন কোনো সমতল ভূমি নাই, তাই সব রাস্তা আঁকাবাঁকা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে। আমরা আশে পাশের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে থাকি আর আফসোস করতে থাকি আগে কেন আসলাম না।
চুখা ড্যাম এ ডিনার
প্রায় ২-৩ ঘন্টা পর আমরা চুখা ড্যাম এর কাছে হোটেল ড্যাম ভিউ তে ডিনার করার জন্য নামি। এই প্রথম আমরা মারাত্মক ঠান্ডার কবলে পড়ি, সবাই কাঁপতে ছিলাম। দৌড়ে কোনোরকমে আমরা হোটেল প্রবেশ করি। গাড়ির ভিতরে এসি চলতে থাকায় বাহিরে যে এতো ঠান্ডা বুজতে পারিনাই।
ড্যাম ভিউ তে ভুটানি, ইন্ডিয়ান খাবার সহ চকলেট, চিপস, ড্রিঙ্কস সব কিছুই পাওয়া যায়। তবে ভুটানিরা খাবারে একধরণে মসলা ব্যবহার করে, আর মোটামোটি সব বাসা, অফিস, রেস্টুরেন্ট এ ধুপ ব্যবহার করে যা থেকে এক ধরণে ঘ্রান আসে। এগুলা একবার নাক দিয়ে ঢুকলে মাথায় সেট হয়ে যায়। তখন আর কোনো কিছু ভালো লাগেনা, কোনো খাবার ভালো লাগেনা। তাই চেষ্টা করবেন নাক বন্ধ রাখতে, আর পরিচিত খাবার খেতে, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান খাবার। ভুলেও ভুটানি খাবার ট্রাই করবেন না।
তবে সব থেকে ভালো হয় চকলেট, ব্রেড, চিপস খেলে। ভুটানে এগুলা অনেক সস্তা। আর হ্যা ভুটানে বাংলাদেশী প্রাণ, বিড এগুলার সব পণ্যই পাওয়া যায়। আমরা ফ্রাইড রাইছ আর চাওমিন অর্ডার করি।
আমি যখন বিয়ার গ্রিলস
কিছুক্ষন পরেই তারা ফ্রাইড রাইছ নিয়ে আসে। লম্বা চালের, প্রায় ৩০% সিদ্ধ, মটরশুটি আর সাথে কিছু সবুজ সবজির ফ্রাইড রাইছ। প্রথম চামিচ মুখে নিয়েই মাথা পুরাই নষ্ট। মুহূর্তের মাঝেই বিয়ার গ্রিলস এর জায়গায় নিজেকে খুঁজে পাই। মনে হচ্ছে দুর্ঘম কোনো স্থানে বিয়ার ভাই এর সাথে বসে অখাদ্য কিছু খাওয়ার চেষ্টা করছি। এমন ফ্রাইড রাইছ আমি তো দূরের কথা আমার চৌদ্দ গুষ্ঠির কেউ খাইছে কিনা সন্দেহ। যাই হোক খেতে তো হবে, তাই চোখ কান বন্ধ করে কিছুক্ষন গিলার চেষ্টা করি। চাওমিনের অবস্থাও একই রকম ছিল। আমরা আসলে এই ধরণে খাবারে অভ্যস্ত না। পরে কিছু চকলেট, চিপস, কোক নিয়ে আবার গাড়িতে উঠি।
অক্সিজেন কম থাকায় সমস্যা
চুখা থেকে ডিনার সেরে আমরা আবার থিম্পুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। অতিরিক্ত উচ্চাতার জন্য অক্সিজেন কম থাকায় আমাদের অনেকেরই সমস্যা হইতেছিল। একজন তো বমি করা শুরু করলো। কম অক্সিজেনে এধরণের সমস্যা হতে পারে। অনেকের মাথা ঘুরায়, বমি বমি লাগে। এই সময় বেশি বেশি করে পানি খেতে, গাড়ির গ্লাস খুলে-বন্ধ করে বডিকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করবেন।
লাইফে প্রথম মাইনাস তাপমাত্রায়
আমরা ঢাকা থেকেই হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। রাত ১১:৩০ দিকে ড্রাইভার আমাদের হোটেলের সামনে নামায় দেয়। থিম্পু তে গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে সবাই শীতে থর থর করে কাঁপতেছিলাম, যদিও সবাই শীতের কাপড় পরে ছিলাম। হোটেলের গেইট বন্ধ থাকায় ২-৩ মিনিট আমাদের বাহিরে দাঁড়ায় থাকতে হয়। এই সময়ে সবার অবস্থা করুন হয়ে যায়। দ্রুত হোটেলে প্রবেশ করে রুমে ঢুকে রুম হিটার চালু করে সবাই কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ি। তাপমাত্রা মেপে দেখি -২ ডিগ্রি!!
জীবনে এই প্রথম মাইনাস তাপমাত্রায় সম্মুখীন হলাম। কিছুক্ষন পরে সব কিছু একটু নরমাল হলে হাত পা ধুয়ে ফ্রেস হলাম। হোটেল থেকে ওয়াইফাই এর পাসওয়ার্ড নিয়ে ঢাকায় পরিবারের সাথে কথা বললাম। আপনারা হোটেল নেবার আগে ওয়াইফাই, গিজার্ড, রুম হিটার আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিবেন। না হলে ঠান্ডায় জমে যাবেন।
থিম্পুতে আমাদের হোটেল
থিম্পুতে আমাদের হোটেল “হোটেল নিউ গ্রান্ড”। এই হোটেলের পরিবেশ খুব ভাল। এখানে ওয়াইফাই, গিজার্ড, রুম হিটার সব কিছুই রয়েছে। রুম, টয়লেট খুবই পরিষ্কার পরিছন্ন। হোটেল থেকে বাহিরের ভিউ অনেক সুন্দর। হোটেল মালিক সোনাম খুবই ভালো এবং সুন্দরী। হোটেলের খাবার একটু ব্যয়বহুল তবে টেস্টি। আপনারা চাইলে এখানে উঠতে পারেন।
পাশে AB নাম আরেকটা হোটেল রয়েছে। AB হোটেলের মালিক ইন্ডিয়ান, তাই সেখানকার খাবার দাবার সব আমাদের জন্য উপযোগী এবং টেস্টি। নিউ গ্রান্ড আর AB হোটেল থিম্পুর মধ্যে এই দুই হোটেলের খাবার দাবার ভালো। আপনার নিউ গ্রান্ড এ থাকতে পারেন আর AB হোটেলের খাবার খেতে পারেন। আমরাও পরে তাই করেছি। রাতে তাপমাত্রা আরো ২-৪ ডিগ্রি কমে যায়। সবাই খুব ক্লান্ত, তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি।
ভুটানে কোথায় থাকবেন, কোথায় খাবার খাবেন
ঝামেলা এড়াতে আপনে আগে থাকেই একটা হোটেলে রুম বুক করে রাখতে পারেন। ঢাকা থেকে গুগল সার্চ করে ফোন নাম্বার বের করে ফোন করে সব বুক করা যায়। মনে রাখা ভালো, ভুটানে দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট সব কিছুই রাত ৭:৩০ থেকে ৮:৩০ এর মধ্যে বন্ধ হয় যায় (দু-একটি দোকান শুধু খোলা থাকে)। তাই হোটেল বা রুম ঠিক না করলে আর ডিনার না করে নিলে খবর আছে।
ভুটানে দামি, কম দামি সব ধরনেরই হোটেল আছে। হোটেলে অবশ্যই দামাদামি করে উঠবেন। যেমন ৭০০-৮০০ রুপি থেকে ১৫ হাজার ++ রুপি পর্যন্ত। আপনি সর্বমিম্ন ৮০০ রুপি আর সর্বোচ্চ ১৫৪০ রুপি দামের হোটেলে থাকতে পারেন। সবগুলো হোটেলই থাকার জন্য নিরাপদ।
ভুটানে ইন্টারনেট একটু স্লো। আপনারা চাইলে একটা ভুটানি সিম কার্ড কিনে নিতে পারেন। আর নিতান্তই দরকার পড়লে ড্রাইভার এর ফোন অথবা হোটেল থেকে দেশে কথা বলতে পারেন। ভুটানে প্রচুর ফ্রেস ফল পাওয়ায় যায়। চেষ্টা করবেন সেগুলা বেশি বেশি খেতে। আমরা প্রতিদিন সকালের নাস্তার সাথে ৩-৪ টা করে ডিম খেয়ে নিতাম। এতে প্রচুর এনার্জি পাওয়া যায়, আর সারা দিন তেমন ক্ষুধা লাগতোনা।
ভুটান ভ্রমণ এর খুচরা কিছু টিপস
ভুটানিরা খুবই অলস জাতি এবং ঘুম কাতুরে। এরা তেমন চাষবাস করেনা অবশ্য সমতল জমিও নাই। খাবার, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ঔষধ, জামাকাপড়, ইত্যাদি সব দরকারি জিনিসপত্রই আসে ভারত থেকে। প্রতিদিন সকালে প্রায় ৪০০ গাড়ি ফুন্টশোলিং থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে ভুটানের বিভিন্ন শহরে আসে।
এরা দৈনিক প্রায় ১২-১৪ ঘন্টা ঘুমায়। তাই সকাল সকাল বের হতে চাইলে আগে থেকেই বলে রাখবেন। ট্যাক্সি, হোটেল দামাদামি করে নিবেন। এরা খুবই শান্তশিষ্ট, তাই অহেতুক এদের খেপাবেন না। কোনো কিছু দরকার হলে পুলিশ কে বলবে। এরা খুবই হেল্পফুল। ভুটানি পুলিশের সাথে কথা বললে আপনার বাংলাদেশী পুলিশ সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যাবে।
তারা তাদের দেশ কে সব সময় পরিষ্কার পরিছন্ন রাখে। তাই পরিবেশ নোংরা করবেন না। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা বা সিগারেট খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হবেন না। তাদের রাজাকে নিয়ে বাজে কিছু বলবেন না। সব সময় খরচ কমানোর চিন্তা করবেন। জামাকাপড় না কিনাই ভালো।
ভুটানে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের কয়েকগুন। তাই সব দোকানপাট, রেস্তোরায় মেয়েই বেশি দেখা যায়। তাদের সম্মান করবেন, নিজেকে সংযত রাখবেন। আপনে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন তা তাদের সাথে শেয়ার করবেন। বাংলাদেশীদের এরা খুব সম্মান করে এবং ভালো জানে। চেষ্টা করবেন তা ধরে রাখতে।
অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:
- পর্ব ১: সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ
- পর্ব ২: থিম্পু শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৩: দোচুলা পাস ভ্রমণ
- পর্ব ৪: পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ ভ্রমণ
- পর্ব ৫: চেলে লা পাস ভ্রমণ
- পর্ব ৬: পারো শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৭: ভুটান ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরা
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।