চেলে লা পাস (Chele La Pass) ভুটানের সব থেকে উচু পাস বা গিরিপথ যার উচ্চাতা প্রায় ১৩৫০০ ফিট। মারাত্বক ঠান্ডা আর বরফের জন্য চেলে লা পাস খুবই বিখ্যাত। পারো শহর থেকে হা ভ্যালি যাবার পথে পরে এই পাস। আজ আমি আপনাদের চেলে লার কথা বলব।
চেলে লা পাস ভ্রমণ
নভেম্বর ২৫, ২০১৭ থিম্পু। আজ থিম্পুতে আমাদের শেষ দিন। সকাল সকাল রেডি হয়ে চেক আউট করার জন্য হোটেলের দ্বিতীয় তলায় চলে আসলাম। আমরা থিম্পুতে আসার পর থেকে এই হোটেলেই আছি। এই কয়দিন এখানে থেকে বেশ ভাল লেগেছে। তাই হোটেল মালিক সোনাম কে ধন্যবাদ দিয়ে নিচে নেমে আসলাম।
এসে দেখি আমাদের ড্রাইভার চলে এসেছে। ওনাকে নিয়েই পাশের এবি হোটেলে চলে গেলাম নাস্তা করতে। এবি হোটেলের খাবার বেশ ভালো। আমরা কিছু ইন্ডিয়ান খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসলাম। আজ আবার অনেকটা লম্বা পথ পারি দিতে হবে। আজকের গন্তব্য ভুটানের আরেক শহর পারো ।
থিম্পু থেকে পারো
থিম্পু থেকে পারোর দুরুত্ব প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। যেতে দুই ঘন্টার মতো সময় লাগে। আমরা অবশ্য প্রথমে শহরে না যেয়ে চেলে লা পাস যাব। সেই একই রকমের পাহাড়ি পথ ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। চারপাশে সব বিশাল বিশাল কালো রঙের পাহাড়।
ড্রাইভার বললো এই কালো পাহাড়ে নাকি ডায়মন্ড মানে হীরা আছে। বিদেশীরা ভুটান কে অফার করেছে এই সব পাহাড় খনন করার অনুমতি দিতে। বিনিময়ে তারা তাদের অনেক টাকা দিবে। কিন্তু ভুটানের রাজা অনুমতি দেয় নাই।
রাজার কথা হলো এইসব পাহাড়ই ভুটানের সমম্পদ। এগুলা থেকেই যা আয় হয় তা দিয়েই চলে ভুটান। পাহাড়ই যদি না থাকে তাহলে ভুটান দেখতে কে আসবে? চিন্তা করেন কত দূরদর্শী! আর আমরা আমাদের সব পাহাড় কেটে শেষ করে দিচ্ছি সামান্য কিছু টাকার লোভে।
চুজুম -চার রাস্তার মিলনস্থল
থিম্পু থেকে আমরা থিম্পু-ফুন্টশোলিং হাইওয়ে ধরে ফুন্টশোলিং এর দিকে এগিয়ে চলেছি। প্রায় ৩০ কিলোমিটার পর চুজুম এলাকার কাছে চোখে পড়লো চার রাস্তার মিলনস্থল। রাস্তা চারটির একটি থিম্পু, একটি ফুন্টশোলিং, একটি হা ভ্যালি এবং একটি পারো শহরের দিকে চলে গেছে।
এখানে ওয়াং চু নদীর উপর রয়েছে এক ব্রিজ। রাস্তার মতো দুটি নদীও এখানে এসে একত্রে মিলিত হয়েছে। জায়গায়টি খুবই সুন্দর। পানির রঙ খুবই চমৎকার। নদীর মারাত্মক স্রোতের কারণে বড় বড় পাথারে এসে পানি সজোরে আছড়ে পড়ছে। আর প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে। এতে একধরণে ধোয়ার মতো বাষ্পের সৃষ্টি হচ্ছে, যা দেখতে মেঘের মতো।
আমরা নেমে ছবি তুললাম। আমার পানিতে নামতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু পানি অনেক ঠান্ডায় থাকায় আর হয় নাই। এখানে কিছু বানর ও রয়েছ। আমরা তাদের সাথে একটু দুষ্টামি করলাম। এখানে একটি পাবলিক টয়লেটও রয়েছে।
পারো নদী
কিছুদূর আগানোর পর সামনে পড়লো পারো চু বা পারো নদীর পারে সুন্দর এক জায়গা। সাথে সাথে আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। জায়গাটি খুবই চমৎকার। নদীর পানি পাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। ভালো স্রোতও আছে।
নদীর পানির রং সবুজ। আশেপাশের সব কিছুও সবুজ। মনে হচ্ছে এইচডি টিভি দেখছি। এত সুন্দর পানির রং হতে পারে আমার ধারণা ছিলোনা। আমরা ছবি তুললাম, নদীতে ব্যাঙ খেললাম পাথর দিয়ে। আমাদের মতো অনেকেই এখানে নেমে ছবি তুলছিলো।
নদীর উপর পারাপারের জন্য রয়েছে এক তারের একটি সেতু। এক পার হতে অপর পারে শক্ত করে একটি তার বাধা আছে। তার সাথে একটি চেয়ার ঝুলানো আছে। চেয়ারে বসে টেনে টেনে ওপারে যেতে হয়। ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেষ্টিং। ড্রাইভার বললো ওপারে ৪ জনের এক পরিবার থাকে। তারা পারাপারের জন্য রাজার কাছে এখানে একটি ব্রীজ তৈরী করে দিতে বলে।
মাত্র ৪ জনের জন্য ব্রীজ বানানো তো আর যায় না। তাই রাজা তাদের পারাপারে জন্য এই ব্যবস্থা করে দেয়। সেই পরিবার ইটা এখন ব্যবহার করে আর এটা দিয়ে ব্যবসাও করে। মাত্র ৫০ রুপী দিয়ে আপনে এই ব্রীজ পার হতে পারবেন। ৫০ রুপী ওই পরিবারই নেয়। অনেক লম্বা লাইন থাকায় আমরা আর উঠতে পারি নাই।
পারো থেকে চেলে লা
পারো এয়ারপোর্টের একটু আগ দিয়ে আমাদের গাড়ি বামে মোর নিলো। আমরা এখন চেলে লার পথে। এখান থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরত্বে চেলে লা পাস। পুরা রাস্তায়ই একদম খাড়া উপরে উঠে গেছে। রাস্তার এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশ অনেক গভীর। তাই বেশ ভয়ংকর। এটি ভুটানে এই কয়দিনে দেখা সব থেকে ভয়ঙ্কর রাস্তা। ড্রাইভার ও তাই বললো।
সবাই খুব ভয় পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের ওপর থেকে দূরে পারো শহরটাকে খেলনা মনে হইতাছিল। আমাদের গাড়িটি মসৃণ গতিতে ভীষণ আঁকাবাঁকা পথ ধরে উপরে উঠে যাচ্ছে। এভাবে বেশ কিছুক্ষন উপরে উঠার পরে মনে হচ্ছে রাস্তা একটু ভালো হচ্ছে। ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে।
ভুটানের অন্য দিকে থেকে এখানকার প্রকৃতি একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে। বড় গাছের সাথে কিছু ছোট ছোট গাছও আছে। আর সব কিছু বিভিন্ন রঙের। শুধুমাত্র সবুজ না। কখনো চোখে পড়ছে পাইন গাছ থেকে ঝুলে থাকা অর্কিড। আবার কখনো রং বেরঙের পাতা, ফুল।
বন্য ষাঁড় এর পাল
একটু পরেই চোখে পড়লো বন্য ষাঁড় এর পাল। তারা দল বেঁধে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখে দারুন লাগলো। আমি ডিসকভারি চ্যানেল ছাড়া এগুলা আগে দেখিনাই। আমরা গাড়ি থামিয়ে ওদের বেশ কাছে থেকে দেখলাম। ষাঁড় গুলো বেশ নাদুস নুদুস। ভুনা করে খেতে যা লাগবেনা। কিন্তু সম্ভব না। ড্রাইভার বললো ভুটানে এগুলা মারা নিষেধ।
এখানকার মানুষ মনে করে এদের খেলে অমঙ্গল হবে। তাই বলে এরা যে মাংস খায়না তা নয়, তারাও খায়। তবে ইন্ডিয়া থেকে এনে। ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম এমন একটা গরুর দাম কত হবে? জানালো ৬ থেকে ৭ হাজার রুপী। বলে কি? ঢাকায় তো এমন একটার দাম ১ থেকে দেড় লক্ষ টাকা হবে।
একবার ভাবলাম এমন ২-৪ তা নিয়ে যাই দেশে। তাহলে ঘুরার খরচ উঠে যাবে, পকেটে কিছু টাকাও থাকবে। কিন্তু ড্রাইভার বললো পুলিশ দেখলে খবর আছে। কি আর করা ব্যবসার চিন্তা বাদ দিয়ে প্রকৃতি দেখায় মনযোগ দিলাম।
চেলে লায় বরফ
আমরা একটু একটু করে শুধু উপরের দিকেই যাচ্ছি। যত উপরে যাচ্ছি আর তাপমাত্রা কমছে। এখন মোটামোটি হিমাঙ্কের নিচে। একটু পরেই দেখি ঝরনার জল পাইন গাছের জঙ্গল বেয়ে বেরিয়ে জমে বরফ হয়ে আছে। জমে থাকা বরফের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, ছুটে চলা সাদা ঘোড়ার দল স্থির ছবি হয়ে গেছে, পাহাড়ের পেটে কোনো এক যাদুকরের মন্ত্রের ছোঁয়ায়।
সাথে সাথেই সবাই চিৎকার করে ড্রাইভার কে বললাম, দাদা গাড়ি থামান। তিনি গাড়ি থামালেন। সবাই দৌড়ে বরফের কাছে চলে গেলাম আর বরফ ধরতে লাগলাম। এতদিন শুধু ফ্রিজের বরফই দেখেছি, ধরেছি। জীবনে এই প্রথম প্রকৃতির বরফ দেখলাম, নিজ হাত দিয়ে ধরলাম।
বরফ দেখে সবাইর মাথা পুরাই নষ্ট। কি রেখে কি করবে বুঝতাছিলনা । আমি মাহমুদ ভাইয়ের জামার ভিতর কিছু বরফ ঢুকিয়ে দিলাম। সাথে সাথেই উনি লাফাতে লাগলো। অনেক্ষন আমরা বরফ নিয়ে খেলাধুলা করলাম। এদিকে ঠান্ডায় সবার হাত জমে যাচ্ছে।
আমরা পাহাড়ি ঝর্ণার মারাত্মক ঠান্ডা পানি খেলাম আর বোতলে ভরে নিলাম। হোটেলে আসা পর্যন্ত বোতলের পানি মোটামোটি একই রকমের ঠান্ডা ছিল। বরফের কারণে আমি পা পিছলে একবার পরে যাই। ভাগ্য ভালো তেমন কিছু হয়নাই। আপনারা এ ক্ষেত্রে একটু সাবধানে থাকবেন। না হলে বিপদ হতে পারে।
মজার কিছু সতর্কবাণী
একটু পর পর চোখে পড়ছে মাইল পোস্টের গায়ে লেখা খুবই মজার এবং চমৎকার কিছু সতর্কবাণী। যেমনঃ “If you are married, divorce speed”, “After Whisky, Driving Risky”, “Drive carefully, heaven is already full”. এগুলো বেশ বড় বড় করেই লেখা আছে, সহজে চোখে পরে। আর আমাদের দেশের মাইল পোস্ট তো চোখেই পড়েনা। ভুটানে সবাই খুব সতর্ক হয়ে গাড়ি চালায়। কেউ কারো ল্যান ছেড়ে যায় না, অযথা হর্ন বাজায় না। তাই এখানে দুর্ঘটনার হার কম।
জমলহারি পর্বত
যাওয়ার পথে দেখলাম জমলহারি পর্বত (Jomolhari) ও জিচু ড্রাকে পর্বত (Jichu Drake)। তারা সাদা পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগতেছিল। জমলহারিকে বলা হয় পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘার বধূ। এটি ভুটানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত। এখানেও তুষার/বরফ জমে।
চেলে লা পাস
অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম চেলে লা পাস। দোচুলা পাস মতো এখানে গাছপালা নাই। দূরে ভুটান-চায়না সীমান্তে পাহাড়ের উপর মেঘ দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে বিশাল কোনো ছাদ। এক পাশে হা ভ্যালির কিছু এলাকা দেখা যাচ্ছে। চেলে লার উপর থেকে সব কিছু অনেক ছোট ছোট মনে হচ্ছে।
পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে চোখে পড়ছে লাটিমের মতো এক ধরনের স্তুপ। এর নাম ‘সা সা’ (tsa tsa)। বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা এগুলা বসায় পুণ্যের আসায়। আরো দেখতে পাচ্ছি অজস্র প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। মূল রাস্তা থেকে একটু উপরে আছে একটি মোবাইল টাওয়ার। আমি আর রিয়াজ ভাই আরো একটু উপরে উঠার চেষ্টা করি। কিন্তু শ্বাসকষ্ট হবার কারণে নেমে আসি। এখান দিয়েই হা ভ্যালি যেতে হয়।
বেয়ার গ্রিলস এর বুড়োর দাড়ি
আমরা হেটে আরো একটু সামনে গেলাম। এক পর্যায় আমি বেয়ার গ্রিলস এর সেই বুড়োর দাড়ি পেয়ে যাই। যেটা দিয়ে উনি প্রায়ই আগুন জ্বালায়। আমিও বেশ কিছু বুড়োর দাড়ি জোগাড় করে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রচুর বাতাস থাকার কারণে আগুন কিছুতেই আর জলছেনা। এক পর্যায় ড্রাইভার বললো এখানে এখন আগুন জ্বালানো ঠিক হবেনা। বাতাস আছে, যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই রেখে দিলাম।
ট্যুরিস্ট বান্ধব চেলে লা পাস
এখানে একটি টয়লেট আছে। কিছু লোক গাড়ির পিছনে করে বিভিন্ন খাবার বিক্রি করছে। খুব ক্লান্ত লাগছে বলে আমরা কোকা কোলা কিনে খাই। অবাক হয়ে গেলাম। প্রায় ১৩ হাজার ফুট উঁচুতেও এরা তেমন কোনো অতিরিক্ত দাম নিলোনা। অথচ আমাদের ১৫ টাকার মাম পানি টুরিস্ট স্পট গুলায় কয়েক গুন হয়ে যায়। চিপস, কোক এর তো একেক জায়গায় একেক দাম। এই জন্যই এখানে প্রচুর বিদেশী টুরিস্ট আসে। আর আমাদের কক্স বাজার এ তেমন কোনো বিদেশী আসেনা। আসবে কিভাবে গেলেতো গলা কাটে।
অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:
- পর্ব ১: সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ
- পর্ব ২: থিম্পু শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৩: দোচুলা পাস ভ্রমণ
- পর্ব ৪: পুনাখা শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৫: চেলে লা পাস ভ্রমণ
- পর্ব ৬: পারো শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৭: ভুটান ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরা
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।