দেবতাখুম (Debotakhum) নেটওয়ার্কের সম্পূর্ণ বাহিরে, নির্জন ও শব্দ বিহীন এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গা। অনেকটা ভুতুড়ে পরিবেশ। দুই পাশে পাথরের উঁচু উঁচু দেয়াল আর তার মাঝ খান দিয়ে সবুজ, শান্ত, স্বচ্ছ পানির জলধারা। এই জলধারা পাড়ি দিতে হয় বাঁশের তৈরী ভেলায় করে।
দেবতাখুম
বান্দরবানকে বলা যায় খুমের স্বর্গরাজ্য। আর এই খুমের রাজা দেবতাখুম। এই খুমের গভীরতা ৫০ থেকে ৭০ ফুট। আর দৈর্ঘ ৬০০ ফুট। এটি ভেলাখুম থেকে অনেক বড় এবং প্রশস্ত। এর দুইপাশে রয়েছে বিশাল জঙ্গল, খাড়া পাহাড়। যার কারণে খুমের ভিতর সরাসরি সূর্যের আলো পৌঁছায় না। তাই ভিতরকার পরিবেশ বেশ শীতল। জায়গাটি খুব শান্ত এবং কোলাহলমুক্ত। এর পানি খুবই স্বচ্ছ এবং সবুজ।
দেবতাখুম কোথায় অবস্থিত
দেবতাখুম বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলায় অবস্থিত।
দেবতাখুম কখন যাবেন
দেবতাখুম সব সময়ই যাওয়া যায়। একেক সময় এর একেক রূপ। বর্ষা কালে পানির প্রবাহ বেশি থাকে। আর শীত কালে কমে যায়। কিন্তু একেবারেই ফুরিয়ে যায়না। তাই ভেলাখুম যাওয়ার সব থেকে ভাল সময় হলো বর্ষার পর পর আর শীতের একটু আগে। মানে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে।
কেননা ভরা বর্ষায় ঝিরি এবং খুমের পানি বিপদসীমার কাছাকাছি থাকায় প্রশাসন থেকে অনেক সময় অনুমতি দেয়না। জোকের প্রাদুর্ভাব একটু বেশি থাকে। পথ পিচ্ছিল হয়ে যায়, যখন তখন বৃষ্টি একটা সমস্যা তৈরী করে।
দেবতাখুম কিভাবে যাবেন
দেবতাখুম যেতে হলে আপনাকে প্রথমেই আসতে হবে বান্দরবান জেলায়। তার পর সেখান থেকে রোয়াংছড়ি উপজেলা। রোয়াংছড়ি থেকে কচ্ছপতলী বাজার। সেখান থেকে শীলবাঁধা পাড়া। শীলবাঁধা পাড়ার কাছেই দেবতাখুম। তবে দেবতাখুমের আগে পং সু আং নামের আরো একটি খুম পার হতে হয়।
রাজধানী ঢাকার কলাবাগান, আরামবাগ থেকে শ্যামলী, হানিফ, সেন্টমার্টিন, দেশ ইত্যাদি পরিবহন কোম্পনীর এসি, নন-এসি, হুন্দাই বাস প্রতিদিন বান্দরবান শহরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং ঢাকায় ফিরে আসে। জনপ্রতি বাস ভাড়া নন-এসি ৫৫০-৭৫০, এসি ১২০০-১৫০০ টাকা। রাতের বাসে রওনা দিলে সকাল ৭ টার মধ্যে চলে আসবেন বান্দরবান।
এছাড়া ট্রেন বা প্লেনে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এসে, চট্টগ্রাম থেকে বাস, প্রাইভেট কার নিয়ে বান্দরবান আসতে পারেন। বদ্দারহাট, ধামপাড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস পাওয়া যায়। ভাড়া ২২০ টাকা। মাইক্রোবাস ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা।
বান্দরবান থেকে কচ্ছপতলী
বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ির দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। রোয়াংছড়ি থেকে কচ্ছপতলী ৫/৬ কিলোমিটার। বান্দরবান শহর থেকে প্রথমে বাসে করে রোয়াংছড়ি যাবেন। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় রোয়াংছড়ির বাস ছাড়ে। ভাড়া ৬০ টাকা। বান্দরবান শহর থেকে সিএনজি, জিপ গাড়ি দিয়েও যাওয়া যায় রোয়াংছড়ি।
পরে ওখান থেকে থেকে সিএনজি নিয়ে চলে যাবেন কচ্ছপতলী। সিএনজি ভাড়া ১৫০ টাকার মতো। এছাড়া আপনি চাইলে বান্দরবান শহর থেকে জিপ গাড়ি ভাড়া করেও সরাসরি কচ্ছপতলী চলে যেতে পারেন। জিপ ভাড়া ১৮০০ টাকা। এক জিপে ১২/১৩ জন বসা যায়।
কচ্ছপতলী থেকে দেবতাখুম
কচ্ছপতলী পৌঁছে ওখানকার আর্মি ক্যাম্পে সবার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, বাসার ফোন নাম্বার, ন্যাশনাল আইডির কপি জমা দিয়ে পারমিশন নিতে হবে। ফটোকপি ঢাকা থেকেই করে নিবেন। ওখানে ফটোকপি করার কোনো দোকান নাই।
তার পর সেখান থেকে একজন গাইড নিতে হবে। গাইড ভাড়া ৫০০ টাকা। আর্মিকে বললে তারা গাইড ঠিক করে দিবে। অথবা নিজেও গাইড ঠিক করতে পারবেন। এই গাইড আপনাকে পথ দেখিয়ে দেবতাখুম নিয়ে যাবে।
গাইড ঠিক করার পর ট্রেকিং শুরু করবেন দেবতাকুমের উদ্দেশ্যে। এটি মোটামোটি মাঝারি মানের ট্রেকিং রুট। কচ্ছপতলী থেকে দেবতাখুম পৌঁছাতে ১ থেকে ১.৫ ঘন্টার মতো সময় লাগবে। পাহাড়, বন, নদী ঝিরির পাশ দিয়ে ট্রেকিং করে আগাতে থাকবেন। ঝিরি পার হতে হয় কয়েকবার।
একসময় পৌঁছে যাবেন শীলবাঁধা পাড়ায়। এই পাড়াই মূলত আপনার বেজক্যাম্প। পাড়ার পাশে শীলবাঁধা ঝর্ণা নামে একটি ঝর্ণা আছে। যাওয়া বা আসার পথে ওটাও দেখে আসতে পারবেন।
শীলবাঁধা পাড়া থেকে ২০/২৫ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন দেবতাখুম। এর পর বাঁশের ভেলা নিয়ে খুমে ঘুরে বেড়াবেন। ফিরার সময় একই পথে আবার ফেরত আসবেন।
কোথায় খাবেন
সকালের নাস্তা বান্দরবান শহরেই করে নিবেন। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট আছে। এর মধ্যে রূপসী বাংলা এবং কলাপাতা রেস্টুরেন্ট বেশ ভালো মানের। ৫০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে নাস্তা হয়ে যাবে। কচ্ছপতলী পৌঁছে ট্রেকিং শুরু করার আগেই দুপুরের খাবারের অর্ডার করে নিবেন। নাহলে পরে ট্রেকিং শেষ করে এসে খাবার নাও পেতে পারেন।
কচ্ছপতলীতে ৩/৪টি খাবারের দোকান আছে। অর্ডার করার পরেই তারা রান্না করে। মুরগীর মাংস, ডাল, আলুভর্তা থাকে মেনুতে। খাবারের বিল আসবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মতো।
কোথায় থাকবেন
সকালে বান্দরবান শহর থেকে দেবতাখুম এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই আবার শহরে ফেরত আসা যায়। তাই সেদিন রাতেই ঢাকা অথবা আপনার গন্তব্যে ফিরে আসতে পারেন। অথবা থাকতে চাইলে বান্দরবান শহরে থাকতে পারেন। এখানে বিভিন্ন মানের বেশ কিছু হোটেল আছে।
বান্দরবানের কয়েকটি হোটেল
বান্দরবান শহরে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ আছে। বান্দরবান শহরের আশেপাশেই তাদের অবস্থান। বান্দরবান শহরে কিছু পরিচিত হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ :
- হোটেল হিল ভিউ: রুম ভাড়া ১২০০ থেকে ২৮০০ টাকা। শহরের মূল বাস স্ট্যান্ডের পাশে।
- রিভার ভিউ: রুম ভাড়া ৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা। শহরের ভিতর সাঙ্গু নদীর পাড়ে।
- হোটেল নাইট হ্যাভেন: রুম ভাড়া ১৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা। শহর থেকে ৪ কিঃমিঃ দূরে নীলাচলের কাছে।
- হোটেল প্লাজা: রুম ভাড়া ১৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা।
- পর্যটন মোটেল: রুম ভাড়া ১২০০ থেকে ২৫০০ টাকা। শহর থেকে ৪ কিঃমিঃ দূরে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স এর কাছে।
ভ্রমণ টিপস এবং সতর্কতা
খরচ কমাতে চাইলে ছুটির দিন পরিহার করুন এবং দলগত ভাবে ভ্রমণ করুন। ট্রেকিং এর জন্য ভালো গ্রিপের জুতা নিবেন। সাঁতার না জানলে এবং বর্ষাকালে গেলে লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখুন। পাথুরে পথ অনেক পিচ্ছিল, তাই সাবধানে হাঁটবেন। বিদ্যুৎ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই। তাই মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক চার্জ দিয়ে রাখুন।
কেবল কাঁধের ব্যাগ সাথে নিবেন এবং ব্যাগের ওজন যত কম হয় সেই দিকে খেয়াল রাখুন। প্যারাসিটামল, গ্যাসের ঔষধ, স্যালাইন ইত্যাদি দরকারি ঔষধ সাথে রাখুন। দল ছাড়া একা কোথাও যাবেন না। দলের বাকি সদস্যদের খেয়াল রাখুন। একজনের বিপদে এগিয়ে আসুন। আদিবাসীদের সাথে ভালো আচরণ করুন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।