দোচালা পাস বা দোচুলা পাস (Dochula Pass) ভুটানের সব থেকে সুন্দর পাস। এই পাস্ রাজধানী থিম্পু থেকে পুনাখা শহরে যাবার পথে পরে। পাহাড়ী এলাকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার সময় দুই স্থানের মাঝখানের সব থেকে উঁচু জায়গাকে পাস বলে। এর উচ্চতা প্রায় ১০০০০+ ফিট। আপনাদের আজ আমি আমার দোচালা পাস ভ্রমণ এর গল্প বলবো।
দোচুলা পাস ভ্রমণ
নভেম্বর ২৪, ২০১৭। সকাল সকাল নাস্তা সেরে আমরা পুনাখা শহর ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু করি। আমরা আগের রাতেই এর জন্য বড় একটি জিপ গাড়ি ভাড়া করে রাখি। পুনাখা যাবার জন্য আলাদা করে পারমিশন নিতে হয়, যা আমরা আগের দিনই থিম্পু থেকে নিয়ে রেখেছি। যেটা নিয়ে গত পর্বে কিছু তথ্য দিয়ে ছিলাম। কেউ পরে না থাকলে পরে নিতে পারেন।
গাড়ি ভাড়া
থিম্পুতে বড় গাড়ি একটু নিচের দিকে স্টেডিয়ামের পাশে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ভাড়া করা যায়। না চিনলে পুলিশকে জিজ্ঞেস করবেন। উনারা দেখায় দিবে। আমরা সাঙরু নামে এক ড্রাইভারকে পেয়ে যাই। আমরা ৩ দিনের জন্য ১১০০০ রুপী দিয়ে তার গাড়ি ভাড়া করি। পুনাখা শহর যাবার জন্য জন্য ৩৫০০, পারো যাবার জন্য ৩৫০০, পারো থেকে ইন্ডিয়ার হাসিমারা পর্যন্ত আসার জন্য ৪০০০, এই মোট ১১০০০ রুপী।
হাসিমারা এসে ৫০০ রুপী তাকে বকশিস দিয়েছিলাম। সাঙরু খুব ভালো মানুষ, ভালো গাড়ি চালায়, আর ভালো গাইড ও বটে। আমাদের কাছে ভাড়াও একটু কম নিয়েছিল। ভুটানে পরবর্তী সব দিন গুলো সে আমাদের সাথে ছিল।
দোচুলা পাস এর রাস্তা
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। যতদূর চোখ যায় শুধু বিশাল বিশাল পাহাড় আর পাহাড়। সবগুলা পাহাড় কাছাকাছি আর উঁচু উঁচু এক ধরণের পাছপালায় ভর্তি। চারিদিকের সব কিছু সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে রয়েছে আপেল, বেদনা ইত্যাদি বিভিন্ন ফলের বাগান।
আশপাশ জনমানব শুন্য। অনেক দূর পর পর পুলিশের গাড়ি আর কিছু মহিলাদের ফলের দোকান সাজিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আমরা গাড়ি থামিয়ে কিছু আপেল কিনে নিলাম। আপেল গুলা একদম ফ্রেশ। মনে হল কেবলই গাছ থেকে পেরে এনেছে। খেতে দারুন লাগলো।
দোকানের পাশেই মেহেদী ভাই একটা খালি পানির বোতল ফেলে দিল, আর সাথে সাথেই এক মেয়ে বললো পুলিশ দেখলে ৩০০০ রুপি জরিমানা করবে। সাথে সাথে ওটা আবার আমরা গাড়িতে তুলে ফেলি। আপনার কিন্তু ভুলেও এই কাজ টি করবেন না।
দোচুলা যাবার রাস্তাটিও বেশ চমৎকার। মাঝে মাঝে মেঘ এসে রাস্তা ঢেকে দেয়। রাস্তার দুইপাশে বেশ লম্বা লম্বা গাছ। প্রায় সবগুলো গাছের ডাল নিচের দিকে হেলানো। ড্রাইভার জানালো ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে এখানে অনেক ভারি তুষারপাত হয়। সেই তুষারপাতের চাপে ডাল গুলোর এই অবস্থা।
দোচুলা পাস এ আমরা
কিছুক্ষন পরেই আমরা চলে আসলাম দোচুলা পাস। পাহাড়ের চূড়ায় সুন্দর এক নিদর্শন। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই বেশ ঠান্ডা অনুভব করলাম। বাতাস ও রয়েছে ভাল। আমরা হেটে এর উপরে উঠে গেলাম। উঠার সাথে সাথেই সবার শাসকস্ট হতে লাগল। অতিরিক্ত উচ্চতা আর কম অক্সিজেনের জন্যই এমনটা হয়। আমরা একটু রেস্ট নিয়ে নরমাল হবার চেষ্টা করি।
এর একপাশ অনেক খারা এবং ঢালু। যাদের উচ্চতায় সমস্যা আছে তারা একটু সাবধানে যাবেন। আমরা ঘুরে ঘুরে দোচুলার অপূর্ব দৃশ্য দেখি আর প্রচুর ছবি তুললাম। দুর্ভাগ্য দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে কিছু দেখতে পারলাম না। ওটা নাকি রাজার বিশেষ মেহমানের জন্য। সেখানে আমাদের অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত এক পরিবারের সাথে কথা হল। তারাও আমাদের মতো ভুটান ভ্রমণে এসেছে।
মেঘ, বৃষ্টি আর কুয়াশা না থাকলে এখান থেকে হিমালয় পর্বতমালার মোট দশটি পর্বতচুড়া দেখা যায়। এটি ভুটানের অন্যতম একটি দর্শনীয় ও পবিত্র স্থান। পাহাড়ের চূড়ায় এ জায়গাটি একেবারেই ছবির মতো সাজানো৷ ভুটান ভ্রমণে গেলে সবাই অবশ্যই এই জায়গাটি ঘুরে দেখবেন।
জায়গাটিতে নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বরফ পড়ে। এখানে একটি সুন্দর ক্যাফেটেরিয়া আছে। ইচ্ছে হলে কফি-স্ন্যাকস খেয়ে নিজেকে চাঙা করে নিতে পারেন। কারো যদি পুনাখায় যেয়ে রাফটিং করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে এখান থেকেই যোগাযোগ করতে পারেন। এই ক্যাফেটেরিয়াতেই যোগাযোগের ফোন নম্বর দেয়া আছে। যারা মোটর বাইক ভাড়া নিতে চান তারাও এই খান থেকে নিতে পারেন
সতর্কতা
অতিরিক্ত উচ্চতার কারণে মাউন্টেন সিকনেস হতে পারে। এতে শরীরের অক্সিজেন লেভেল কমে যায়। তাই শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘুড়ানো বা বমি হতে পারে। তাই বেশি বেশি করে পানি খাবেন। কিছু ঔষধ আছে যা দেহের অক্সিজেনর পরিমান বাড়ায়। সেগুলা খেতে পারেন। খুব বেশি কিনারে যাবেন না, পা পিছলে পরে যেতে পারেন। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।
অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:
- পর্ব ১: সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ
- পর্ব ২: থিম্পু শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৩: দোচুলা পাস ভ্রমণ
- পর্ব ৪: পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ ভ্রমণ
- পর্ব ৫: চেলে লা পাস ভ্রমণ
- পর্ব ৬: পারো শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৭: ভুটান ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরা
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।