কলকাতা যাচ্ছেন? কোথায় থাকবেন? কি খাবেন? কোথায় শপিং করবেন? ইত্যাদি একটি বড় সমস্যা। যাবার আগেই সব কিছু ভাল ভাবে জেনে নেয়া উত্তম। তানাহলে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন, আপনার পকেট ফাঁকা হয়ে যেতে পারে। আসুন জেনে নেই কলকাতায় কোথায় থাকবেন, কি খাবেন বিস্তারিত (Hotels at Kolkata)।
কলকাতায় কোথায় থাকবেন
নানা প্রয়োজনে কলকাতা এখন আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘুরাঘুরি, কেনাকাটা, চিকিৎসা ইত্যাদি কাজে সারা বছরই বাংলাদেশ থেকে প্রচুর লোক কলকাতা যেয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসে সর্ব প্রথম বড় যে ঝামেলায় পড়তে হয় তা হল কলকাতায় কোথায় থাকবেন? আপনার জন্য ভালমানের একটি গেস্ট হাউস বা হোটেল পাওয়া খুবই জরুরি।
এখানে প্রতি দিনের জন্য হোটেল ভাড়া ৩০০ রুপি থেকে শুরু হয়ে ৫০০০ রুপি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর মাস খানেক চিকিত্সার জন্য যারা আসবেন তাদের ১ রুমের ভাড়া ২০-২৫ হাজার রুপি হতে পারে। তাই এখানে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কলকাতা শহর অনেক বড়, আর এলাকা ভেদে হোটেল খরচ আলাদা হয়ে থাকে। তাই আপনে কোন কাজে এসেছেন তার উপর ভিত্তি করে হোটেল বাছাই করা উত্তম।
আপনি কলকাতায় কোথায় থাকবেন
আপনি যদি কেনাকাটা এবং ঘুরাঘুরির জন্য কলকাতা এসে থাকেন তাহলে শহরের কেন্দ্রীয় ব্যবসায়িক এলাকা হিসাবে পরিচিত মধ্য কলকাতায় হোটেল বাছাই করবেন। এই ক্ষেত্রে সদর স্ট্রীট, ফ্রী স্কুল স্ট্রীট (মির্জা গালিব স্ট্রীট), মারকুইস স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রীট এর হোটেল গুলো হবে আপনার জন্য আদর্শ।
এই সব এলাকায় রয়েছে কলকাতা নিউমার্কেট, এসপ্ল্যানেড, চাঁদনী চৌক, ডালহৌসি স্কোয়্যার, বিগ বাজার। আসে পাশে আছে প্রচুর শপিং মল, যেখান থেকে আপনি আপনার দরকারি সব জিনিসপত্র কিনতে পারবেন। কলকাতায় ঘুরাঘুরির জন্য সব স্থাপনা গুলো এই এলাকাতেই অবস্থিত এবং এখান থেকে আপনি যেকোনো জায়গায় সহজে যেতে পারবেন। বাংলাদেশ থেকে আসা সকল গাড়িগুলো মারকুইস স্ট্রিটে এসেই থামে।
আর যদি চিকিৎসার জন্য এসে থাকেন তাহলে যেই হসপিটালে চিকিৎসা নিবেন তার আসে পাশে থাকার চেষ্টা করবেন। সব থেকে ভাল হয় আসার আগেই গুগল ম্যাপ দেখে আপনার সম্ভব্য এলাকা গুলোর বিষয়ে ধারণা নিয়ে আসা। তাহলে হোটেল বাছাই এবং ট্যুর এর পরিকল্পনা করতে অনেক সুবিধা হয়।
কলকাতায় আমার হোটেল
এবার আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। বাংলাদেশ থেকে আমি আজ দুপুরেই সড়ক পথে কলকাতা এসেছি। আমি কিভাবে কলকাতা আসলাম তা আপনারা চাইলে দেখে নিতে পারেন। আমার এবার কলকাতা আসার উদ্দেশ্য ঘুরাঘুরির এবং কেনাকাটা। তাই সিদ্ধান্ত নেই নিউমার্কেটের কাছেই থাকব। আর নিউমার্কেটের সব থেকে কাছেই হল সদর স্ট্রিট।
তাই হোটেল বাছাই করি The Salvation Army Red Shield Guest House। কিছু দিন আগেই আমার অফিসের কিছু কলিগ এসে এখানে থেকে গেছে। তারাই আমারে এই হোটেল রেফার করে। বাংলাদেশ থেকে আসার আগেই আমি জেনে নেই আমার গাড়ি এসে থামবে মারকুইস স্ট্রিটে। গুগল ম্যাপে দেখে নেই সেখান থেকে হোটেল খুবই কাছে, হেঁটেই যাওয়া যাবে।
কলকাতায় দালালদের বিড়ম্বনা
গাড়ি থেকে নেমে ব্যাগ নিয়ে হেটেই যেতে থাকি সদর স্ট্রিট। পাশেই দেখি অনেক দালালরা ডাকাডাকি করছে আর বলছে দাদা কম দামে ভাল হোটেল আছে। আমার হোটেল সিলেক্ট করা আছে বলে হাটা দেই। তাও দেখি এক লোক পাশে পাশে হাটছে আর নানা অফারের কথা বলছে।
আমি বললাম দাদা আমার হোটেল কনফার্ম করা আছে, নামও বলে দিলাম, আপনি চলে যান আমি একা যেতে পারব। তাও সে পিছু ছাড়ছেনা। বিভিন্ন হোটেলে দৌড়ে যাচ্ছে কোনো রুম ফাঁকা আছে কিনা জানার জন্য। সে ভিতরে গেলেই আমি জুড়ে হাটা শুরু করি। আবার সে দৌড়ে চলে আসে। ভাবি এই কোন টাউটের পাল্লায় পড়লাম আজ। যাই হোক আমি আমার হোটেলে চলে আসি।
কলকাতায় আমার হোটেল
আমি ঢাকা থেকে রুম কনফার্ম করে আসি নাই। তাই একটু চিন্তায় ছিলাম। রিসিপশনে কথা বলে জানলাম রুম ফাঁকা আছে। ডাবল বেড, প্রতিদিনের ভাড়া ৩০০০ রুপি। চলে গেলাম রুম দেখতে। কয়েকটা দেখে একটা ফাইনাল করি। বললাম ২-১ মাস আগে আমার বন্ধুরা এসে এখানে থেকে গেছে, ওরাই আপনাদের হোটেল রেফার করেছে। অবশেষে ২৫০০ রুপিতে কনফার্ম করি।
আপনারা চাইলে আমার রেফারেন্স দিতে পারেন। তাহলে কিছু ডিসকাউন্ট পাবেন। বৌয়ের কোথায় ওই টাউট কে ৩০ রুপি দিয়ে বিদায় করি। চাবি নিয়ে রুমে চলে যাই। কলকাতায় এই ধরণের টাউট লোক ভর্তি। হোটেল খোঁজা , শপিং, মুদ্রা এক্সচেঞ্জ ইত্যাদি নানা জায়গায় এরা ভর্তি। এদের কোনো কাজ নেই বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে ২০-৩০ রুপি যা পায় ওটা দিয়েই চলে। এদের কাছে থেকে সাবধান থাকবেন।
Red Shield Guest House হোটেল টি খুবই চমৎকার। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, যারা আর্মিদের নিয়ে কাজ করে এটিকে চালায়। আর্মিরা চালানোর জন্য এটি বেশ পরিপাটি, আর নিরাপত্তাও ভাল। সামনে কিছু ফাঁকা জায়গা রয়েছে। হোটেলের জানালা খুললেই নিউমার্কেট দেখা যায়। হোটেলের দেয়ালের সাথেই ন্যাশনাল মিউজিয়াম। গেট দিয়ে বের হলেই সোজা কয়েক মিনিটের হাটা দুরুত্বে নিউমার্কেট।
বিদ্যুৎ, জেনারেটর, ফ্রি ওয়াইফাই, লিফ্ট, কমপ্লিমেন্টারি নাস্তা ইত্যাদি রয়েছে। রুমে টয়লেট, টেলিভিশন, টেলিফোন সবই আছে। এক কথায় ফ্যামিলি নিয়ে থাকার জন্য আদর্শ। এখানে কোনো সিঙ্গেল রুম নাই। তবে ডরমিটরি আছে যেখেনে এক রুমে অনেক লোক থাকে। ভাড়া ৭৫০ রুপি। ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতা গেলে আপনারা এখানে থাকতে পারেন।
কলকাতায় কি খাবেন
কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করার পর পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হল কি খাবেন, কোথায় খাবেন? কলকাতার খাবার দাবার অনেকটাই আমাদের দেশের মত হলেও এরা একধরণের মসলা ব্যবহার করে যার জন্য অনেকেরই খেতে অসুবিধা হয়। তাই ভালো রেস্টুরেন্ট বাছাই করা জরুরি। কলকাতায় প্রচুর খাবার হোটেল পাবেন যার প্রায় প্রতিটি মেনুই আপনার পরিচিত।
কস্তুরী হোটেল
তবে মারকুইস স্ট্রিট এ অবস্থিত কস্তুরী হোটেলটিতে একবার হলেও খাবেন। এখানকার প্রতিটি আইটেমই অনন্য এবং টেস্টি। একবার খেলে তার স্বাধ সারাজীবন মনে থাকবে। তবে এর জায়গা অনেক ছোট এবং সবসময় ভিড় লেগেই থাকে, মনে হবে আমাদের ষ্টার কাবাব। তাই আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে।
আর যদি নিরিবিলি পরিবেশ চান তাহলে চলে যান সদর স্ট্রিটে কস্তুরীর আরেক ব্রাঞ্চে। এই ব্রাঞ্চটি নতুন, ছিমছাম, নীরব, খাবারের সাদ আমাদের দেশের মতোই। এদের কঁচুপাতা, চিংড়ি, সরিষা দানা দিয়ে রান্না করা অসম্ভব এক টেস্টি আইটেম আছে যা এখনো জিবে লেগে আছে। একবার হলেও এটা চেখে দেখবেন। বেগুন ভাজি, মুরগি বাটা খুবই টেস্টি।
আমার হোটেলের কাছে হওয়াতে এবং খাবারের মানের কারণে কলকাতায় পরবর্তী পাঁচ দিন এখানেই খেয়েছি। এরা ক্রেডিট কার্ডও নেয়। খাবার শেষে গরম গরম গোলাপ জাবুন খেতে দারুন লাগে। সব মিলিয়ে দুইজনের খরচ পরে ৪০০-৪৫০ রুপি।
কলকাতার অন্নান্ন খাবার
এদের পিজা খুব টেস্টি আর দামেও সস্তা। ডোমিনাস পিজা মাত্র ৯৯ রুপি থেকে শুরু। একবার খেয়ে দেখতে পারেন। আমি প্রথম দিনে ডোমিনাস থেকে পিজা আর কেএফসি থেকে ফ্রাইড রাইস, চিকেন খাই। দারুন টেস্ট, তবে না জেনে পিজা কাস্টমাইজ করতে যাবেন না, তাহলে ঝামেলা হতে পারে। মেয়ে ভাত আর মুরগির মাংস ছাড়া অন্য কিছু খেতে চায় না বলে আবার কস্তুরীতে ফেরত যাই।
কলকাতায় প্রচুর স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। স্বাস্থসম্মত, দামেও সস্তা। খেয়ে দেখতে পারেন। এদের দই, মিষ্টি খুবই মজাদার। এগুলা অবশ্যই খাবেন। এখানে মিষ্টির জগতে হালদিরাম হল অভিজাত ব্র্যান্ড। একবার হলেও খাবেন। জায়গায় জায়গার প্রচুর জুসের দোকান পাবেন, একদম ফ্রেশ। গরমে আরাম পেতে ২-১ গ্লাস মেরে দিতে পারেন।
কলকাতায় চকলেট, চিপস খুবই সস্তা। বেশি বেশি করে খাওয়ার চেষ্টা করবেন। আর গলা ভিজাতে সফ্ট ড্রিঙ্কস খাবেন। এদের সফ্ট ড্রিঙ্কস আমাদের থেকে অনেক ভাল।
কলকাতায় আরেকটা ইউনিক জিনিস হল মাটির ভাঁড়ের (কাপ) চা। এখানকার মাটির কাপে চা খেতে ভুলবেন না যেন। দাম মাত্র ১০ রুপি। খেতে আহামরি তেমন কিছু না হলেও স্বাস্থসম্মত, আর অন্নরম একটা ব্যাপার কাজ করে।
সতর্কতাঃ
কলকাতায় আগে রুম না দেখে কনফার্ম করবেন না। তাহলে ঠকার সম্ভবনা ১০০%। আর প্রয়োজন না হলে দেশ থেকে অগ্রিম রুম বুকিং করে আসার দরকার নাই। তবে ২-৪ টা হোটেল সম্পর্কে জেনে আসবেন। রোজার ঈদের আগে আসলে ১ দিনের জন্য বুকিং করে আসতে পারেন। তখন অনেক ভিড় থাকে। দামাদামি করে রুম ভাড়া ঠিক করবেন। সাথে একাধিক লোক থাকলে এক জন কে পাঠাবেন রুম ঠিক করতে, বাকিরা ব্যাগ নিয়ে কোথাও অপেক্ষা করবেন। দালাল চক্রের কাছ থেকে সাবধানে থাকবেন। মালা মাল নিজ দায়িত্বে রাখবেন।
অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:
- পর্ব ১: সড়ক পথে কলকাতা ভ্রমণ
- পর্ব ৩: কলকাতায় কোথায় কেনাকাটা করবেন
- পর্ব ৪: কলকাতায় কোথায় ঘুরাঘুরি করবেন
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।