কার্গিল থেকে সোনমার্গ যাওয়ার রাস্তাটি খুবই ভয়ংকর এবং সুন্দর। এই পথেই পারি দিতে হয় পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর জোজিলা পাস। যা পার হতে ড্রাইভার যাত্রী সবারই বুক ধড়ফড় করে। যখন তখন পাথর ধসে পড়া, বরফগলা জল এসে রাস্তা ভাসিয়ে দেয়া, ধসে পড়া রাস্তা ইত্যাদি এই পথের নিয়মিত ব্যপার। শীতকালে প্রচন্ড তুষারপাতের কারণে এই সড়ক প্রায় ৬ মাস বন্ধ থাকে। আসুন জেনে নেই সড়ক পথে কার্গিল টু সোনমার্গ যাবার বিস্তারিত।
কার্গিল টু সোনমার্গ
সেপ্টম্বর ১৯, ২০১৮ কার্গিল। কাশ্মীরে আজ আমাদের চতুর্থ দিন। কাল রাতে আমরা লেহ থেকে কার্গিল এসেছি। ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি সবাই রেডি হয়ে নিলাম। একটু পরেই আমরা সোনমার্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিব। সেখানে পৌঁছেই নাস্তা করব।
রাতে আসায় কার্গিল শহরের কিছুই দেখতে পারিনাই। তাই সকালে রওনা দিবার আগে আশে পাশে একটু দেখে নিলাম। কার্গিল শহর ছিমছাম গুছানো। কার্গিল লেহ থেকে একটু নিচে এবং কিছু গাছপালা থাকায় AMS এর তেমন কোন সমস্যা নাই।
একবার মনে হলো হোটেলের পিছনে কি আছে দেখা দরকার। কেন সেখান থেকে এত শব্দ আসছে যার কারণে রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয়েছে। হোটেলের পিছন দিকের বারান্দায় গিয়ে মাথা পুরা নষ্ঠ। অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ি সুরু নদী। নদীতে তীব্র স্রোত। পাথরের গায়ে পানি লেগে প্রচন্ড শব্দের সৃষ্ট্রি করছে।
সকাল ৭:৩০ এর দিকে আমরা আবার সোনমার্গের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। কার্গিল থেকে সোনমার্গের দূরত্ব প্রায় ১২৩ কিঃমিঃ। যেতে ৩ ঘন্টার মতো সময় লাগে। সুরু নদীকে এক পাশে রেখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে।
একটু পর পর আর্মিদের বিভিন্ন গৌরবের স্মৃতি বড় বড় পাথরে লেখা আছে। ক্যাপ্টেন সিং.. মেজর অমুক ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা কবে কোথায় মারা গেছে, কবে জন্ম গ্রহণ করেছে। এইসব দেখে মনটা কেমন জানি হয়ে গেল।
তাই আবার অপর পাশে তাকাই। সুরু নদীর পানি খুব সুন্দর কালারফুল। নদীর দুইপাশে ছোট ছোট গাছপালা, পাথর, মাঝে মাঝে নদীর উপর সুন্দর কাঠের ব্রীজ। এসব দেখে মনে হল আহঃ আমার বাড়িটা যদি এমন একটা জায়গার হতো তাহলে কতই না ভালো হতো।
দ্রাস ভারতের শীতলতম স্থান
একটু পর আমরা চলে আসলাম দ্রাস শহরে। এটি কার্গিল জেলার অন্তর্গত ছোট এক শহর। এই শহরকে লাদাখের প্রবেশদ্বার (The Gateway to Ladakh) বলা হয়। এটি কার্গিল শহর থেকে প্রায় ৬০ কিঃমিঃ দূরে শ্রীনগর ও লেহ শহরের সংযোগরক্ষাকারী ১ডি নং জাতীয় সড়কের ওপর দ্রাস উপত্যকার মাঝে অবস্থিত। এই শহরের গড় উচ্চতা ১০,৭৬৪ ফুট।
এটি ভারতের শীতলতম স্থান এবং পৃথিবীর মধ্যে মানুষ বাসযোগ্য দ্বিতীয় শীতলতম স্থান। এখানে অক্টোবর-মের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রচন্ড কষ্টদায়ক শীতকাল অবস্থান করে। শীতে গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -২২ ডিগ্রী সে। ডিসেম্বর-মে প্রায় ১৪ ইঞ্চি তুষারপাত হয়। জুন-সেপ্টেম্বরের শুরু পর্যন্ত দ্রাসে গ্রীষ্মকাল। এই সময় গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সে। এই দ্রাসেই ১৯৯৯ সালে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয় যা কার্গিল যুদ্ধ নামে পরিচিত। এখানের প্রায় সব লোকই মুসলিম।
পুরা এলাকাটা দারুন সুন্দর। এখান থেকেই সবুজ কাশ্মীরের শুরু বলা যায়। চার পাশে ছোট ছোট দূর্বা ঘাস, রঙিন সব বাড়ি ঘর, মাঝখানে অপূর্ব সুন্দর সিন্ধু নদী সব মিলিয়ে পুরা দ্রাস উপত্যকা এক কথায় চমৎকার।
আমরা গাড়ি থেকে নেমে প্রচুর ছবি তুললাম, দ্রাসের লোকদের সাথে কথা বললাম, সেই বিখ্যাত সিন্ধু নদীর পারে চলে গেলাম, পানি দিয়ে দুষ্টামি করলাম। দ্রাস উপত্যকায় সিন্দু নদী খুবই খুবই সুন্দর। এবার মনে হলো আমাদের বাড়িটা এখানে থাকলেই বুঝি বেশি ভালো হতো।
দ্রাস বালক ইনজামাম ও মুদাস্সের জানালো শীত কাল তারা অনেকটা ঘরের ভিতরেই কাটিয়ে দেয়। বাহিরে বের হয়না, সব কিছু বরফে ঢেকে যায়। এখানে একধরণের গাছ জন্মে যা দিয়ে তারা শীত কালে আগুন জ্বালায়। বরফ গলিয়ে যে পানি পাওয়া যায় তা দিয়েই চলে রান্নাবান্না, জামাকাপড় ধোয়া। তবে শুকাতে নাকি বেশ বেগ পেতে হয়।
তাদের একজনের ১০ জন করে ভাই বোন। তারা তাদের ঘর দেখালো, আমরা তাদের কিছু চকলেট, বিস্কুট দিলাম। ভীষণ খুশি হলো। এই ফাঁকে আমাদের ড্রাইভার ঝর্ণার জল দিয়েই তার গাড়ি পরিষ্কার করে নিলো। ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেষ্টিং মনে হলো।
স্থানীয় বাজার থেকে আমরা কিছু পানি কিনে আবার চলা শুরু করলাম। ড্রাইভার আমাদের একটু পর পর কার্গিল যুদ্ধের বিভিন্ন ধ্বংস বিশেষ দেখাচ্ছে আর বর্ণনা করছে। আমরা টাইগার হিলের পাশ দিয়েই যাচ্ছি। এই টাইগার হিলের অপর পারেই পাকিস্তান। ১৯৯৯ এ এই পাহাড়ে উঠেই পাকিস্তানীরা গুলি বর্ষণ শুরু করে। তাদের গুলির আঘাতে বিদ্ধস্ত দেয়াল এখনো রয়েছে। এই দেয়া ঘেঁষেই আমাদের গাড়ি সামনে আগাচ্ছে।
কার্গিল টু সোনমার্গ সড়কে ভেড়ার পাল
একটু পরেই সামনে পড়ল বিশাল ভেড়ার পাল। কয়েক হাজার ভেড়া, ছাগল ৩-৪ জন লোক তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য আমাদের গাড়ি যেতে পারছেনা। ড্রাইভার জানালো তারা না যাওয়া পর্যন্ত আমরা যেতে পারবোনা। হর্ন দেয়া বা তাদের কোনোরকম আঘাত করা বেআইনি। তাহলে জরিমানা হবে। লোকাল সরকার থেকে এমন আদেশই দেয়া আছে।
এগুলা আগে হিন্দি ছিনেমায় দেখেছি, নায়ক নায়িকার পথ আগলে রেখেছে ভেড়ার পাল। কিন্তু আজ নিজ চোখে দেখে এবং একই পরিস্থিতিতে পরে দারুন লাগলো। সেই অভিজ্ঞতা। কাশ্মীরে এগুলা খুবই নরমাল ব্যাপার। পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েক বার এই পরিস্থিতে পড়েছি।
জোজিলা পাস
এর পর আমরা চলে আসলাম সেই ভয়ংকর জোজিলা পাসে (Zoji La Pass)। এটি কার্গিল টু সোনমার্গ যাওয়ার ১ডি নং জাতীয় সড়কের ওপর অবস্থিত। এটি কাশ্মীর ও লাদাখের মধ্যে সংযোগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোনমার্গ থেকে এর দুরত্ব ৯ কিঃমিঃ। এর উচ্চতা ১১,৫৭৫ ফুট। শীতকালে এটি বরফে ঢেকে যায়। তাই এই হাইওয়ে প্রায় ৬ মাস বন্ধ থাকে।
এটি খুবই দুর্গম। সব সময় এখানে পাথর ধসে পরে, বরফ গলা পানি এসে রাস্তা নষ্ঠ করে ফেলে। তাই সব সময়ই এর মেরামত করা লাগে। একটু পর পর লেখা আছে রক ফলিং এরিয়া ড্রাইভ কেয়ারফুলি। এই পাস পার হতে বেশ সময় লেগে যায়। অবশ্য ইন্ডিয়ান সরকার এখানে পাহাড়ের নিচ দিয়ে টানেল বানাচ্ছে যা জোজিলা টানেল নামে পরিচিত। এই টানেল হয়ে গেলে সারা বছরই শ্রীনগর-লেহ হাইওয়ে খোলা থাকবে। তখন পার হতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগবে।
জোজিলা পাস এ ট্রাকের জ্যাম
এই পাসের পিক পয়েন্ট খুবই সরু আর ভয়ংকর। এখানে প্রায়ই জ্যাম লেগে যায়। তখন পার হতে বেশ সময় লাগে। এখানে আসার আগে আমি মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যাতে গিয়ে দেখি জ্যাম লেগে গেছে। কারণ বিশাল বিশাল ট্রাকের জ্যামই জোজিলা পাসের আসল সৌন্দর্য, আমার কাছে।
মনে হলো আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে। এসেই দেখি পিক পয়েন্টে দুই ট্রাক আটকে আছে। আমরা তাড়াতাড়ি গাড়িথেকে নেমে যাই। ট্রাকের লোকেরা জ্যাম সরানোর চেষ্টা করছে। এই অল্প একটু জায়গা দিয়ে বিশাল বিশাল ট্রাকগুলো কিভাবে যায় ভাবতেই অবাক লাগে। সাইড দেয়ার সময় ট্রাকের চাকার কিছু অংশ রাস্তার বাহিরে চলে যায়, যেখানে কোনো মাটি নাই। একটু এদিক সেদিক হলেই কয়েক হাজার ফুট নিচে।
এখানে প্রচুর ঠান্ডা, পাথর গুলো বরফের টুকরো হয়ে আছে। কয়েকটা হাতে নিয়েই বুজতে পারলাম এগুলা অনেক শক্ত, একদম লোহার মতো আর সাইজের তুলনায় ওজন অনেক বেশি। এতো শক্ত বলেই এরা এতো বিশাল ট্রাকের ভার বইতে পারে।
মাথার ওপারে পাথর ঝুলতাছিলো, একবার খসে পড়লেই কেল্লা ফতে। সড়কের সাইডে গেলেই পা কাঁপতে থাকে। নিচে কয়েক হাজার ফুট গভীর। এতো ভয়ংকর হলেও জোজিলা পাস অনেক অনেক সুন্দর। উপর থেকে সামনের ভিউ অসাধারণ।
আমাদের ড্রাইভার ফাঁক দিয়ে গাড়ি বের করে নিয়ে এসেছে। জ্যাম তখনও লেগে আছে। আমরা আবার চলা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে বরফ গলা জল রাস্তা ভাসিয়ে দিচ্ছে। পানির উপর দিয়েই গাড়ি চলে যাচ্চে। এখানকার রাস্তার কোনো পিচ নাই। পাথর আর পানি এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
বালতাল ভ্যালি
জোজিলা পাস থেকে প্রায় ১০-১২ কিঃমিঃ এগোতেই পৌঁছে গেলাম অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের বেস ক্যাম্প বালতাল ভ্যালি (Baltal Valley)। এখান থেকে অমরনাথ গুহার দূরত্ব মাত্র ১৪ কিমি। ফলে দিনে দিনেই যাত্রা শেষ করে ফিরে আসা যায়। তবে পুরা রাস্তা ট্রেকিং করে যেতে হয়। পহেলগাঁও থেকেও অমরনাথ গুহায় যাওয়া যায়। তবে দুই দিন ট্রেকিং করা লাগে। পাহাড়ের উপর থেকে নিচে সবুজ বালতাল ভ্যালি অসাধারণ। আমরা আবার সামনের দিকে যেতে থাকলাম।
বালতাল ভ্যালি থেকে আরো ১৫ কিঃমিঃ এগোতেই সকাল ১০:৪৫ এ আমরা পৌঁছে গেলাম সোনমার্গ। আমাদের গাড়ি একটি মুসলিম রেস্টুরেন্ট এর সামনে এসে থামল। গাড়ি থেকে নেমে দুই পাশের সবুজ পাহাড় দেখে দারুন লাগল। আমরা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে রুটি আর সবজি দিয়ে নাস্তা করে নিলাম।
তবে রেস্টুরেন্ট এর টয়লেটে গিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে মাথা নষ্ঠ। বাহিরের সবুজ পাহাড় অসাধারণ। প্রথিবীর আর কোনো টয়লেট থেকে এতো সুন্দর ভিউ হবেনা।
কার্গিল টু সোনমার্গ ভ্রমণ শেষে
আমাদের আজকের জার্নি আপাদত এখানেই শেষ। একটু পর আমরা ঘোড়ায় চড়ে সোনমার্গ এর আসল সৌন্দর্য উপভোগ করবো।
অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:
- পর্ব ১: লাদাখ এবং কাশ্মীর ভ্রমণ
- পর্ব ২: লাদাখের দর্শনীয় স্থান সমূহ
- পর্ব ৩: সড়ক পথে লেহ টু কার্গিল
- পর্ব ৪: সড়ক পথে কার্গিল টু সোনমার্গ
- পর্ব ৫: পৃথিবীর স্বর্গ সোনমার্গ
- পর্ব ৬: এশিয়ার সুইজারল্যান্ড পেহেলগাম
- পর্ব ৭: কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।