সাধারণত প্রতিটি খুমই খুব সুন্দর। এদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। আর যদি এমন কয়েকটি খুম একত্রে মিলে সৃষ্টি করে খুমের রাজ্য (Kingdom of Khum), তাহলে তো দারুন ব্যাপার। এক সাথে কয়েকটি সুন্দর সুন্দর খুম দেখা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। আসুন দেখি তেমনি এক খুমের রাজ্যের ট্যূর প্ল্যান।
খুম কি
মারমা ভাষায় খুম মানে হলো জলাধার। এখানে জল বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে আঁকাবাঁকা পথ পারি দিয়ে এক জায়গায় এসে পড়ে আর সৃষ্টি করে অদ্ভুদ আকৃতির প্রাকৃতিক একুরিয়াম। খুমের আগে বা পরে জলপ্রপাত, ঝর্ণা, ঝিরি থাকতে পারে।
খুমের রাজ্য কোথায় অবস্থিত
খুমের রাজ্য বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় অবস্থিত। এখানে একসাথে আছে বেশ কয়েকটি অসাধারণ সুন্দর সুন্দর খুম। তাদের মধ্যে নাফাখুম, অমিয়াখুম, ভেলাখুম, সাতভাইখুম, দেবতাখুম উল্লেখযোগ্য।
খুমের রাজ্যে কিভাবে যাবেন
খুমের রাজ্যে যেতে হলে আপনাকে প্রথমেই আসতে হবে বান্দরবান জেলায়। তার পর সেখান থেকে থানচি উপজেলা। থানচি বাজার থেকে খুমের রাজ্যে।
খুমের রাজ্যের ট্যুর প্ল্যান
খুমের রাজ্য অনেক বড় আর দুর্গম। সব কভার করতে কয়েকদিন লেগে যাবে। আর কয়েকবার যেতে হবে। তবে এই ট্যুর প্ল্যান ফলো করলে মোটামোটি চার রাত তিন দিনে খুমের রাজ্য কভার করে আসতে পারবেন। ৪ রাত ৩ দিনের খুমের রাজ্যের ট্যুর প্ল্যান (Kingdom of Khum Tour Plan) মোটামোটি এই রকম:
প্রথম দিন
রাতে রওনা দিয়ে সকালে চলে আসবেন বান্দরবান জেলা শহরে। বান্দরবান শহর থেকে সকালের নাস্তা সেরে বাস বা রিজার্ভ জীপ/চান্দের গাড়িতে চলে আসবেন থানচি। বান্দরবান শহরের থানচি বাস স্ট্যান্ড থেকে এক ঘন্টা পর পর বাস ছাড়ে। জনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা, সময় নিবে ৪-৫ ঘন্টা।
টিম বড় হলে চান্দের গাড়ির নিয়ে যাওয়াই ভালো। সময় নিবে ৩-৩.৫০ ঘন্টা। এক গাড়িতে ১০-১২ জন বসা যায়। যাবার পথে চারপাশের অপূর্ব সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ দেখতে পারবেন, দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারবেন। জীপ/চান্দের গাড়ির ভাড়া ৬০০০ টাকা।
থানচি বাজারে বিজিবি ক্যাম্প থেকে গাইডের তালিকা করে দেয়া আছে। সেখান থেকে আপনাকে একজন গাইড নিতে হবে, এটি নেয়া বাধ্যতামূলক। এর পর সবার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, বাসার ফোন নাম্বার, ন্যাশনাল আইডির কপি, কোথায় যাবেন, কয়দিন থাকবেন ইত্যাদি সব কাগজে লিখে থানা এবং বিজিবি ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হবে। থানায় সবার গ্রূপ ছবি তুলে রাখবে। সব ক্ষেত্রে গাইড আপনাকে সাহায্য করবে।
প্রশাসন থেকে অনুমতি পাবার পর থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করতে হবে। এক নৌকায় ৪-৫ জন বসা যায়। রেমাক্রি পৌঁছাতে সময় নিবে ২.৫ ঘন্টার মতো।
নাফাখুম
রেমাক্রি পৌঁছে, সেখান থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে আরো একজন স্থানীয় গাইড নিতে হবে। এটি থানচি থেকে আসা গাইড ঠিক করে দিবে। এই স্থানীয় গাইড আপনাকে নাফাখুম হয়ে থুইসাপাড়া নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে। রেমাক্রি খাল ধরে পায়ে হেঁটে নাফাখুম পৌঁছাতে ২ থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে।
নাফাখুমে কিছুক্ষন থেকে ছবি তুলে আবার রওনা দিবেন থুইসাপাড়ার দিকে। নাফাখুম থেকে ৩/৪ ঘন্টা ট্রেকিং করেই পৌঁছে যাবেন থুইসাপাড়া। থুইসাপাড়া যেতে বেশি সময় লাগলে এর আগের পাড়া জিনাপাড়ায় রাত কাটাতে পারেন।
এখানে আদিবাসীদের ঘরে পর্যটকদের থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে। তারা খাবারও পরিবেশন করে। ভাত, সবজি, ডাল, আলু ভর্তা, মুরগির মাংস ইত্যাদি মেনু তে থাকে। কি খাবেন তা গাইড কে বলে দিলে উনি সব ব্যবস্থা করে রাখবেন।
দ্বিতীয় দিন
থুইসাপাড়া রাতে থেকে পরের দিন সকালে আরো একজন গাইড নিয়ে রওনা দিবেন দেবতা পাহাড় হয়ে অমিয়াখুমের উদ্দেশ্যে। গাইড ভাড়া ৫০০ টাকা। থুইসাপাড়া থেকে আমিয়াখুম যাওয়ার পথ দুটো। একটা ঝিরি পথ + পাহাড়ি পথ। আরেকটা শুধু পাহাড়ি পথ। যাওয়ার সময় পাহাড়ি পথ ও আসার সময় ঝিরি পথ ব্যবহার করতে পারেন।
কিছুক্ষন পর পৌছে যাবেন দেবতা পাহাড়ের চূড়ায়। দেবতা পাহাড় থেকে নামাটা বেশ কষ্টকর এবং বিপদজনক। তাই সাবধান থাকবেন। অনেক সময় ৮০/৯০ ডিগ্রি খাড়া ভাবে নামতে হয়। নিচে নামতে প্রায় ১ ঘন্টার মতো সময় লাগাতে পারে।
নিচে নেমে ডানের রাস্তা চলে গেছে ভেলাখুম ও নাইক্ষংমুখে এবং বামের রাস্তা চলে গেছে আমিয়াখুম ও সাতভাইখুমের দিকে।
আপনারা প্রথমে অমিয়াখুম যাবেন। এর পর সাতভাইখুম। সব শেষে যাবেন ভেলাখুম। আর অমিয়াখুমে ৫০% সময় বাকি দুইটায় ৫০% সময় দিবেন। সব মিলিয়ে ৩/৪ ঘণ্টা এখানে কাটাবেন। নাহলে সময় কুলাবেনা। তবে যতক্ষণই থাকেন সময়ের দিকটা খেয়াল রাখবেন।
আমিয়াখুম
দেবতা পাহাড় থেকে নেমে ২/৩ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন আমিয়াখুম। থুইসাপাড়া থেকে এখানে আসতে ৩ ঘন্টার মতো সময় লাগবে। তবে টিমের স্টেমিনার উপর নির্ভর করে সময় আরো কিছু কম বেশি লাগতে পারে।
সাতভাইখুম
আমিয়াখুম থেকে সামান্য একটু উপরে উঠলেই সাতভাইখুম। এখানে বিশাল আকৃতির পাথরের পাহাড়ের মাঝ খান দিয়ে শান্ত, সবুজ, স্বচ্ছ জলধারা বয়ে গেছে। এই জলধারায় বাঁশের ভেলায় ঘুরে বেড়াবেন আর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। আসা যাওয়া মিলে ৫০ মিনিটের মতো লাগতে পারে। পানি দেখে নামতে ইচ্ছা করবে। অনেক গভীর, তাই না নামাই ভালো।
ভেলাখুম
আমিয়াখুম থেকে ৫ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন ভেলাখুম। এখানেও বাঁশের ভেলায় ঘুরে বেড়াবেন আর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। উপরের আমিয়াখুম থেকে পানির প্রবাহ এসে এখানে মিলিত হয়েছে। কিছুদূর সামনে এগিয়ে আবার ভেলা থেকে নেমে যাবেন। এর পর বিভিন্ন পাথর পেরিয়ে নতুন আর একটা ঝর্ণার কাছে যাবেন। যার নাম ন্যাইক্ষারমুখ।
একই পথে থুইসাপাড়ায় ফেরত এসে সেখানেই রাত্রি যাপন করবেন।
তৃতীয় দিন
পরের দিন সকালে নাস্তা করে একই পথে থানচি ফেরত আসুন। থানচি থেকে বান্দরবান শহরে চলে আসুন। মাঝখানে কোথাও লাঞ্চ করে নিন। ডিনার করে রাতের গাড়িতে ফিরে চলে যান আপনার গন্তব্যে।
ভ্রমণ টিপস এবং সতর্কতা
খরচ কমাতে চাইলে ছুটির দিন পরিহার করুন এবং দলগত ভাবে ভ্রমণ করুন। ট্রেকিং এর জন্য ভালো গ্রিপের জুতা নিবেন। সাঁতার না জানলে এবং বর্ষাকালে গেলে লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখুন। পাথুরে পথ অনেক পিচ্ছিল, তাই সাবধানে হাঁটবেন। থানচির পর বিদ্যুৎ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই। তাই মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক চার্জ দিয়ে রাখুন।
কেবল কাঁধের ব্যাগ সাথে নিবেন এবং ব্যাগের ওজন যত কম হয় সেই দিকে খেয়াল রাখুন। প্যারাসিটামল, গ্যাসের ঔষধ, স্যালাইন ইত্যাদি দরকারি ঔষধ সাথে রাখুন। দল ছাড়া একা কোথাও যাবেন না। দলের বাকি সদস্যদের খেয়াল রাখুন। একজনের বিপদে এগিয়ে আসুন। আদিবাসীদের সাথে ভালো আচরণ করুন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।