লেহ শহর (Leh City) লাদাখের লেহ জেলার সদরদপ্তর। গুজরাট রাজ্যের কচ্ছ জেলার পর, লেহ জেলা আয়তনের দিক থেকে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে লেহ শহর ৩,৫২৪ মিটার বা ১১,৫৬২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। এই শহর চারিদিকে হিমালয়ের পর্বত দ্বারা বেষ্টিত। এর আয়তন প্রায় ৪৫,১১০ বর্গ কিঃমিঃ। ২০০১ সালের হিসাব অনুযায়ী এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় ২৭,৫১৩ জন।
লেহ শহর এর দর্শনীয় স্থান
লেহ শহরে এবং এর আশেপাশে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। আর লেহ শহরের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান সমূহ দেখা কে লেহ সাইট সিং বলে। এই লেহ সাইট সিং এর মাঝে পরে ম্যাগনেটিক হিল, সঙ্গম পয়েন্ট, গুরুদুয়ারা পাথর সাহেব, হল অফ ফেম, শান্তি স্তুপা, লে প্যালেস, সে প্যালেস, থিকসে মনাস্ট্রি, থ্রি ইডিয়টস স্কুল, লেহ মার্কেট ইত্যাদি। এগুলার জন্য মোটামোটি একদিন হলেই চলে এবং কোন পারমিশন এর দরকার নাই। লেহ সাইট সিং এর জন্য গাড়ি ভাড়া নিবে ২৫০০ রুপি।
ম্যাগনেটিক হিল
ম্যাগনেটিক হিল বা গ্রাভিটি হিল হল এমন এক জায়গা যেখানে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে রাখলেও গাড়ি আপনা আপনি এগিয়ে চলে। এটি আসলে এক ধরণের অপটিক্যাল ইলুশন বা দৃষ্টি ভ্রম। মানে আশেপাশের পরিবেশ এমন একটি পরিস্থিতির তৈরী করে যাতে ঢালু রাস্তাকে উঁচু রাস্তা মনে হয়। বেপারটা খুবই ইন্টারেষ্টিং। পৃথিবীতে এমন জায়গা বেশ কিছু আছে। লাদাখের লেহ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিঃমিঃ দূরে লেহ-শ্রীনগর হাইওয়ে তে রয়েছে এমন একটি ম্যাগনেটিক হিল। যেখানে গাড়ি প্রায় ২০ কিঃমিঃ/ঘন্টা বেগে সামনে এগিয়ে যায়। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৪,০০০ ফুট।
সঙ্গম পয়েন্ট
লাদাখের দুই নদী ইন্দুস আর জান্সকার এসে যে জায়গায় মিলিত হয়েছে তার নাম সঙ্গম পয়েন্ট। মূল জায়গাটি বেশ নিচুতে। জায়গাটি খুবই চমৎকার। নদীর জল ঘোলাটে এবং শীতল। এখানে রাফটিং করার ব্যবস্থা আছে। এখানে কিছু লাদাখী জিনিসপত্র পাওয়া যায়। সেখান থেকে উপরের দিকে উঠে আসলে একটা জায়গা থেকে সঙ্গম পয়েন্ট এর সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়, লোকে একে সঙ্গম ভিউ পয়েন্ট বলে। ম্যাগনেটিক হিল থেকে কার্গিলের দিকে আরো প্রায় ৫ কিঃমিঃ সামনে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে এই সঙ্গম পয়েন্ট।
গুরুদোয়ারা পাথর সাহেব
গুরুদোয়ারা পাথর সাহেব শিখ ধর্মালম্বিদের এক ধর্মীয় স্থান। এটি লেহ শহরের কাছে প্রায় ১২০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। ১৫১৭ সালে শিখদের প্রথম গুরু, গুরু নানক লাদাক এসেছিলেন। উনার সম্মানেই সেই সময়ে এটি বানানো হয়। এখানে সব সময় ফ্রিতে খাবার পরিবেশন করা হয় যাকে লঙ্গর বলে। এখানে খেয়ে নিজের প্লেট নিজেই পরিষ্কার করে রাখতে হয়। পাশেই আর্মি ক্যাম্প, আর্মির লোকজনও এখানে খাবার খায় এবং স্বেচ্ছায় কাজ করে। আর্মিরাই সব কিছু ম্যানেজ করে। লাদাখে আসলে অবশ্যই এখানে লাঞ্চ করে নিবেন।
হল অফ ফেম
হল অফ ফেম আসলে একটি আর্মি মিউজিয়াম। ইন্ডিয়ান আর্মিদের বিভিন্ন যুদ্ধের স্মৃতি, অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, সাজুয়াজান ইত্যাদি অনেক কিছু এখানে সাজানো আছে। ভিতরে প্রবেশ করতে ২০ রুপির টিকেট কাটা লাগে।
থিকসে মনাস্ট্রি
থিকসে মনাস্ট্রি লেহ শহর থেকে প্রায় ২০ কিঃমিঃ দূরে লেহ-মানালি হাইওয়েতে অবস্থিত। প্রায় ৬০০ বছর পুরানো এবং ১২ তলা বিশিষ্ট থিকসে মনাস্ট্রি লাদাখি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। ভিতরে প্রবেশ করতে ৩০ রুপির টিকেট কাটা লাগে। থিকসের প্রধান আকর্ষণ হল দোতলা সমান বৌদ্ধ মূর্তি যা ১৯৭০ সালে নির্মিত হয়েছিল, দালাই লামার থিকসে আগমন উপলক্ষে। এখানে আরো রয়েছে অসংখ্য স্তূপ, থাংকা, দেওয়ালচিত্র, মূল্যবান পুঁথি ও মন্দির। এর ছাদ থেকে আশেপাশের ভিউ অস্থির সুন্দর।
থ্রি ইডিয়টস স্কুল
আমির খানের সেই বিখ্যাত মুভি থ্রি ইডিয়টস যে স্কুলে শুটিং হয়েছিল সেটি এখন একটি ভাল ট্যুরিস্ট স্পট। স্কুল কতৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ট্যুরিস্টদের জন্য নির্ধারিত সময়ে মুভির শুটিং স্পট গুলো ভিসিট করা যায়। এখানে আছে সেই বিখ্যাত ইডিয়টিক ওয়াল, ক্যাফে। ক্যাফের খাবার একদম ফ্রেশ, অসাধারণ তার টেস্ট। স্কুলের গেইটের বাহিরের দিকটাও অনেক সুন্দর। ছোট ছোট সাদা রঙের স্থাপনাগুলো অসাধারণ।
সে প্যালেস
সে প্যালেস (Shey Palace Leh) লেহ শহর থেকে প্রায় ১৫ কিঃমিঃ দূরে লেহ-মানালি হাইওয়েতে সে গ্রামে অবস্থিত। একসময় এটি লাদাখের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল। লাদাখের রাজা, দেলদান নামগয়াল ১৬৫৫ সালে এটি নির্মাণ করেন। তিনি একই বছর তার বাবার স্মরণে এখানে একটি মনাস্ট্রি তৈরী করেন, যা সে মনাস্ট্রি (Shey Monastery) নামে পরিচিত। দুইটা এক সাথে সে প্যালেস কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। পুরা কমপ্লেক্স একটি টিবির উপর অবস্থিত। প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক আসে একে দেখার জন্য। বাহির থেকে দেখতে অনেকটা সিরিয়ার বিধ্বস্ত কোনো প্রাসাদের মতো মনে হলেও সে প্যালেস খুবই সুন্দর।
লেহ প্যালেস
লেহ প্যালেস (Leh Palace) লেহ শহরে এক পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। তিব্বতের পাতলা প্যালেসের (Potala Palace) আদলে নির্মিত ৯ তলা এই ভবনটি এক সময় লাদাখ রাজ্যের রয়েল প্যালেস ছিল। লাদাখের রাজা সেনজ্ঞে নামগয়াল ১৬ শতকে এটি নির্মাণ করেন। সব থেকে উপরের তলায় রয়েল পরিবার বসবাস করত। আর নিচের দিকে ছিল ষ্টোর রুম, অশ্বশালা ইত্যাদি। বর্তমানে এটি মিউজিয়াম এবং প্রবেশ ফি দিতে হয়। লেহ প্যালেস এর ছাদ থেকে লেহ শহর এবং আশেপাশের এলাকার সুন্দর প্যানোরোমিক ভিউ পাওয়া যায়।
শান্তি স্তুপা
শান্তি স্তুপা (Shanti Stupa) লেহ শহরে অবস্থিত বৌদ্ধ ধর্মের এক ধর্মীয় স্থান। এটি ১৯৯১ সালে জাপানিরা নির্মাণ করেন। প্রায় ১১,৮৪১ ফুট উপরে অবস্থিত সাদা রঙের এই স্তুপা দেখতে দারুন সুন্দর। এখান থেকে পুরা লেহ শহরের সুন্দর প্যানোরোমিক ভিউ পাওয়া যায়। এর রাতের সৌন্দর্য কোন অংশে কম নয়। তাই বিকালে গেলে ভালো, যাতে একসাথে দিন-রাতের ফ্লেভার পাওয়া যায়। একেবারে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত হওয়ায় এখানে প্রচুর বাতাস, যার ফলে মারাত্মক ঠান্ডা। উচ্চতার কারণে AMS এর সমস্যা হয়। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে উঠা লাগে। তবে এতো প্রতিকুল হলেও লেহ গেলে কোনো ভাবেই একে না দেখে চলে আসবেন না।
লেহ সিটি মার্কেট
লেহ সিটি মার্কেট (Leh City Market) লাদাখ এলাকার প্রধান এবং সব থেকে বড় মার্কেট। মার্কেট টি দেখতে খুবই সুন্দর এবং পরিষ্কার। দুই পাশে সারি সারি দোকান, মাঝখানে ফাঁকা, যেখানে বেশ কিছু বেঞ্চ দেয়া আছে বসার জন্য। দেখে মনে হবে যেন ইউরোপের কোনো স্থান। এখানে ভালো মানের উলের কাপড় এবং স্থানীয় হস্তশিল্প আইটেম পাওয়া যায়। এখানে my father was in Ladakh, my brother was in Ladakh, my sister was in Ladakh ইত্যাদি নানান ধররের লেখা সম্বলিত টিশার্ট পাওয়া যায়। দাম ৩০০-৪০০ রুপি। এখানকার আপেলের টেস্ট কিন্তু দারুন, খেতে মিস করবেন না।
লেহ শহর এ কোথায় থাকবেন
লেহ শহর থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। একেক টায় একেক ধরনের খরচ। কোনোটায় রুম ভাড়ার সাথে খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাই ভাড়া নেয়ার সময় জেনে নিবেন। আর গিজার, ওয়াইফাই আছে কিনা দেখে নিবেন। চেষ্টা করবেন ওল্ড টাউন এর দিকে থাকতে। তাহলে একটু আরাম পাবেন।
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।