নর্থ সিকিম ভ্রমণের জন্য আলাদা করে পারমিশন নিতে হয়। গ্যাংটকের কিছু ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ভ্রমণ প্যাকেজ নিলে এই পারমিশন পাওয়া যায়। সিকিম ভ্রমণ কাহিনীর এই পর্বে আমি নর্থ সিকিম ভ্রমণ প্যাকেজ কিভাবে নিলাম, কেমন খরচ হলো এবং রাতে গ্যাংটক শহরে ঘুরাঘুরির অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো।
নর্থ সিকিম ভ্রমণ প্যাকেজ
সারাদিন গ্যাংটকের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করে খুব টায়ার্ড ছিলাম। তাই দুপুরে হোটেলে এসে ঘুম দেই। ঘুম থেকে উঠি সন্ধ্যার পর। টিম মেম্বার মাজহার ভাইকে কল দিয়ে জানতে পারলাম বাকি সবাই এম জি মার্গ এ আছে। পরিবারের সদস্যদের রুমে রেখে আমি চলে গেলাম এম জি মার্গ। নর্থ সিকিম যাবার প্যাকেজ ফাইনাল করে হোটেলে এসে ওদের নিয়ে যাবো।
নর্থ সিকিম যেতে হলে সরকার নির্ধারিত কোনো ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে প্যাকেজ এবং পারমিশন নিতে হয়। প্যাকেজ গুলো সাধারণত ১ রাত ২ দিনের হয়। ইচ্ছে করলে ২ রাত ৩ দিনের প্যাকেজও নিতে পারেন। তখন খরচ বেড়ে যাবে। এই প্যাকেজ এর মধ্যে পারমিশন ফি, আসা যাওয়ার গাড়ি ভাড়া, হোটেল ভাড়া এবং খাবার খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে।
প্যাকেজের মধ্যে উনারা ইয়ুমথাং ভ্যালি পর্যন্ত নিয়ে যাবে। জিরো পয়েন্ট বা কাটাও যেতে চাইলে গাড়ির ড্রাইভার কে অতিরিক্ত ফি দিতে হবে। ড্রাইভার কত নিবে তা উনার সাথে দরদাম করে ঠিক করে নিতে হয়। সাধারনণত ড্রাইভার ৪,০০০/৫,০০০ রুপি নেয়।
আমরা এম জি মার্গে ২/৩ টি এজেন্সিতে গিয়ে তাদের প্যাকেজ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলাম। আমাদের কাছে সানফ্লাওয়ার ট্রাভেল এজেন্সির প্যাকেজ ভালো মনে হলো। উনারা আমাদের ৮ জনের জন্য ১ রাত ২ দিনের প্যাকেজ নিলো ১৯,০০০ রুপি। লাচুং এ কেমন হোটেল দিবে, খাবারে কি কি থাকবে, গাড়ি কেমন হবে সব কথা বলে নিলাম।
নর্থ সিকিম ভ্রমণ প্যাকেজ নিতে কি কি ডকুমেন্টস লাগে
নর্থ সিকিমের পারমিশন নিতে প্রত্যেকের ১ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, পাসপোর্ট এবং ভিসার কপি, ইনার লাইন পারমিশন এর কপি ট্রাভেল এজেন্সিতে জমা দিতে হয়। এজেন্সরি লোকজন অনলাইনে আবেদন করে পার্মিশনের ব্যবস্থা করে দেয়। আমরা প্রয়জনীয় সব ডুকুমেন্টস এজেন্সিতে জমা দিলাম। সাথে কিছু পেমেন্ট করলাম।
আমাদের বললো সকালের মধ্যে পারমিশন হয়ে যাবে। পার্মিশনের কপি নিয়ে আমাদের লোক ভজরা ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে থাকবে। বাকি পেমেন্ট উনার কাছে দিয়ে দিবেন। আপনারা ১০ তার মধ্যে ভজরা ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে চলে যাবেন। অথবা এখানে এসে এখান থেকেও যেতে পারেন। আরো বললো সাথে থাকা অতিরিক্ত লাগেজ ইচ্ছে করলে এখানে রেখে যেতে পারেন। আমরা সেই লোকের ফোন নাম্বার নিয়ে এজেন্সি থেকে চলে আসি।
সানফ্লাওয়ার এজেন্সির সুবিধা
সানফ্লাওয়ার ট্রাভেল এজেন্সিতে এসে আরো অনেক বাংলাদেশীদের সাথে দেখা হলো। কারো গ্রূপ আছে, কারো গ্রূপ নেই। যাদের গ্রূপ নেই তারা এখানে এসে অন্যদের সাথে মিলে গ্রূপ ঠিক করে নিচ্ছে। গ্রূপে গেলে খরচ অনেক কমে যায়। এজেন্সির মালিক খুব ভালো এবং বাংলা বলতে পারে। উনি ইন্ডিয়ান এবং বাংলাদেশীদের জন্য আলাদা আলাদা গ্রূপ করে দিলেন।
এজেন্সিতে একজন বাংলাদেশী দম্পতিকে পেলাম। উনারা শিলিগুড়ি থেকে বাইক ভাড়া করে গ্যাংটক এসেছেন। বাংলাদেশীদের নর্থ সিকিম বাইক নিয়ে যাবার পারমিশন নাই। তাই উনি অন্য একটা গ্রূপের সাথে যোগ দিলেন। শিলিগুড়ি থেকে বাইকে গ্যাংটক আসার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা আমাদের সাথে শেয়ার করলেন।
নর্থ সিকিম যাওয়ার প্রত্যেক গাড়ির সাথে একজন গাইড থাকা বাধ্যতামূলক। আমরা যেহেতু ৮ জন। তাই গাড়িতে অতিরিক্ত একজন গাইড বসলে আমাদের বসতে কষ্ট হয়ে যাবে। এজেন্সির মালিকে ব্যাপারটি বললাম। উনি বললো কাল আমার এখান থেকে আরো গাড়ি যাবে। যাদের গাড়িতে যাত্রী কম সেখানে গাইডকে বসতে বলবো। আসলে এজেন্সি থেকে যত গাড়ি যায় সব গাড়ির জন্য ১ জন গাইড থাকলেই চলে। সানফ্লাওয়ার এজেন্সি থেকে যেহেতু প্রতিদিন একাধিক গাড়ি যায়, তাই এখানে আপনারা এই সুবিধা পাবেন।
রাতে গ্যাংটক শহরে ঘুরাঘুরি
প্যাকেজ ঠিক করে টিমের অন্য সদস্যরা চলে গেলো রাতের গ্যাংটক দেখতে। আমি হোটেলে ফোন দিয়ে ওয়াইফকে বললাম এম জি মার্গের রেড পান্ডার কাছে চলে আসতে। এটি হোটেলের খুবই কাছেই। সেখান থেকে ওদের নিয়ে প্রথমেই হালকা কিছু নাস্তা করে নেই। ঢাকায় ইন্ডিয়ান খাবার অনেক খেয়েছি। তবে এখানকার গুলোর টেস্ট একদম আলাদা। খেতে খুবই সুস্বাদু এবং দাম বেশ কম। ৩ প্লেট খাবারের দাম নিলো ১২০ রুপি।
গ্যাংটক শহরে শপিং
এম জি মার্গের দুইপাশে প্রচুর দোকান পাঠ, মার্কেট এবং ওপেন মার্কেট আছে। খাবার শেষে আমরা কিছু শীতের কাপড় কেনার জন্য সেখানে চলে গেলাম। এখানে বেশ ভালো কোয়ালিটির শীতের কাপড় পাওয়া যায়। ফুটপাথ থেকে আমি মেয়েদের জন্য পা মোজা, হাত মোজা, কানটুপি কিনে নিলাম। ঢাকায় এগুলোর দাম অনেক বেশি ছিল। আমরা জ্যাকেট, ইনার ঢাকা থেকেই নিয়ে এসেছি। তবে ইছা করলে আপনারা এখান থেকেও কিনতে পারেন। গ্যাংটকে সব কিছু ইন্ডিয়ার অন্য জায়গা থেকে আসে। সম্ভবত তাই অন্য জিনিসপত্রের দাম একটু বেশি। তাই শপিং করার ইচ্ছে থাকলে শিলিগুড়ি থেকে করা ভালো।
এম জি মার্গে ঘুরাঘুরি
শপিং শেষে আমরা পুরো এম জি মার্গ ঘুরে দেখলাম। আই লাভ গ্যাংটক, রেড পান্ডা স্ট্যাচু, মহাত্মা গান্ধী স্ট্যাচু ইত্যাদি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে প্রচুর ছবি তুললাম। এম জি মার্গ আসলেই অনেক সুন্দর। আর রাতে এর সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহুগুন। গভীর রাত পর্যন্ত এখানে মানুষের আনাগুনা থাকে।
আমাদের ১ দিন আগে আমার সাবেক কলিগ শরীফ ভাই গ্যাংটক এসেছেন। এম জি মার্গে উনাদের সাথে দেখা করলাম। উনারা ৩ ফ্যামিলি মিলে এসেছেন। আগামী কাল উনারাও নর্থ সিকিম যাবেন। উনারা আমাদের পাশের হোটেলেই উঠেছে। সেখানকার রুম ভাড়া একটু কম। তাই পরবর্তীতে লাচুং থেকে গ্যাংটক ফিরে এসে উনাদের হোটেলেই উঠবো ঠিক করলাম।
রাতের খাবার
উনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে গেলাম ডোমিনোজ পিৎজার আউটলুটে। ইন্ডিয়া আসলে আমি সব সময় পিৎজা খাওয়ার চেষ্টা করি। এখানে পিৎজা অনেক সস্তা। মাত্র ৯৯ রুপিতে পিৎজা পাওয়া যায়। আমরা সব থেকে ভালো কোয়ালিটির একটা মিডিয়াম সাইজের পিৎজা অর্ডার করলাম। দাম নিলো ৯৫০ রুপি। পিৎজা খেয়ে হেটে হেটে আবার হোটেলে ফিরে আসলাম।
রাতে গ্যাংটকে প্রচুর ঠান্ডা পরে। তাই হোটেলে আসতে আসতে ঠান্ডায় একদম জমে গেলাম। হোটেলে এসে দেখি টিমের বাকি মেম্বাররা সবাই আগেই চলে এসেছেন। উনাদের সাথে পরবর্তী দিনের প্ল্যান শেয়ার করে রুমে চলে গেলাম। আগামী কাল আমরা নর্থ সিকিম যাবো।
নর্থ সিকিম ভ্রমণ প্যাকেজ নিয়ে কিছু পরামর্শ
- কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি যাচাই করে প্যাকেজ নিবেন।
- হোটেল কেমন দিবে, গিজার থাকবে কিনা জেনে নিবেন।
- কয় সিটের গাড়ি তা হিসাব করে গ্রূপ ঠিক করবেন।
- গাড়ি কেমন দিবে জেনে নিবেন।
- গ্যাংটকে সব কিছু রাত ৯ তার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।
সিকিম ভ্রমণের গল্প
আমার রাতের গ্যাংটক ভ্রমণ কাহিনী আপনাদের কেমন লাগলো জানাবেন। সিকিম ভ্রমণের আরো অভিজ্ঞতা জানতে বাকি পর্ব গুলো দেখে নিতে পারেন। আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে।
- পর্ব ১: ঢাকা থেকে গ্যাংটক
- পর্ব ২: গ্যাংটক শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৪: গ্যাংটক থেকে নর্থ সিকিম
- পর্ব ৫: ইয়ুমথাং ভ্যালি এবং জিরো পয়েন্ট
- পর্ব ৬: ছাঙ্গু লেক ভ্রমণ
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।