১৫০ বছর আগের হোটেলে রাত্রি যাপন, রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে পদ্মার পারে বসে সময় কাটানো, রাজশাহীর বিখ্যাত কালাই রুটি দিয়ে ঝাল হাসের মাংসের ডিনার, বাংলাদেশের সর্ব প্রাচীন ৪০ ঘর বিশিস্ট মাদ্রাসা ঘুরে দেখা, ছোট সোনা মসজিদের দুপুরের নামাজ আদায়, চাপাইনবাবগঞ্জের ট্রাক ড্রাইভারদের খাবার জন্য বিখ্যাত হোটেলে ভাত খাওয়া, আমাদের রাজশাহী ভ্রমনের অভিজ্ঞতা এক কথায় অসাধারন এক অভিজ্ঞতা!!
প্রথমেই বলে নিচ্ছি আমরা ধরা বাধা নিয়মে ঘুরতে যাইনি এখানে, এটা রিলাক্স ট্যুর ছিল, সবগুলো স্পট কভার করা হয়নি কিন্তু এমন অনেক জায়গায় গিয়েছিলাম যেগুলো কোন পর্যটন স্পট না, কিন্তু খুব সুন্দর এবং আমরা অনেক লোকাল ফুড ট্রাই করেছি।
আমরা গিয়েছিলাম
- সোনা মসজিদ।
- দারাসবাড়ি মাদ্রাসা -প্রাচীন বাংলার প্রথম মাদ্রাসা।
- দারাসবাড়ি মসজিদ (অতি প্রাচীন এক মসজিদ এর ধ্বংসাবশেষ )।
- টি বাধ ( পদ্মা নদীর উপর বাধ দেয়া হয়েছে , যার এই পাড়ে বাংলাদেশ অপর পাড়ে ভারত)।
- চাপাইনবাবগঞ্জ এর এক আমের বাগান।
আমরা থেকেছিলাম
প্রায় ১৫০ বছর পুরনো একটা হোটেলে যেটা কালের বর্তমানে – ক্লিনিক (ব্রিটিশ পিরিওডে), থাকার বাড়ি, কমিউনিটি সেন্টার এবং বর্তমানে হোটেল হিসেবে পরিচালিত আছে।
কি কি খেলাম
- রাজ পাড়ার জনপ্রিয় গরম মিষ্টি আর নিমকি।
- টি বাধ এর বার ভাজা (ঝাল্মুরির মতো ১২ রকমের উপকরন দিয়ে এক প্রকার খাবার )।
- উপশহরের শিক কাবাবের বার্গার। মাত্র ৩০ টাকা হলেও টেস্ট কোন অংশে কম না।
- রাজশাহীর বিখ্যাত কালাই রুটি, বেগুন ভাজা, হাসের মাংশ, এবং কাচা মরিচের সালাদ।
- চাপাই এর গোদাগারী এলাকায় একটা ড্রাইভারদের খাবার জন্য একটা হোটেল আছে কম করে হলেও ১৫/১৬ রকমের গরু, মুরগির, হাস, কয়েল,কবুতর এর মাংস ভর্তা, ভাজি, মাছ রান্না করা থাকে সেখানে।
- মিস্টার বুলেট এর মশলার চা।
রাজশাহী ভ্রমনের অভিজ্ঞতা
গত মাসের শেষ এর দিকে বন্ধু ইফতি চিটাগং থেকে ফোন দিয়ে বলে বৃহস্পতিবার সে ঢাকা আসছে, রেডি হয়ে থাকতে। একসাথে রাজশাহী যাবে আমাদের আরেক বন্ধু আসিফ এর বাড়িতে। আমি তখন ছিলাম ভালুকা কোন এক কাজের জন্য। আমার ৩/৪ দিনের প্ল্যান বাদ দিয়েই ঢাকা ব্যাক করলাম।
শুক্রবার সকালে শুরু হল আমাদের যাত্রা। সকাল ৯ টায় রওনা দিলেও যেতে যেতে বাজল রাত ৮ টা। কারন ইফতি গাড়ি ৮০র উপরে উঠায় না কখনই। আসিফ এর হোটেলেই উঠলাম। এই হোটেলটা আসিফরা প্রায় ২০ বছর আগে কিনেছিল। এটা ছিল ব্রিটিশ সময়ের একটা বাড়ি।
প্রথমে একজন ব্রিটিশ ডাক্তার তার ক্লিনিক বানিয়েছিলেন, এরপর একজন ভারতীও নিজের বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন। পরে স্বাধীনের পর এটাকে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তারপর আমার বন্ধুর বাবা সেটাকে কিনে নিয়ে হোটেল বানান। বিল্ডিংটায় কোন পিলার নেই। কারন প্রত্যেকটা দেয়াল ২০ ইঞ্চি করে। তাই দেয়ালই পিলারের কাজ করছে।
রাজ পাড়ার গরম মিষ্টি
আমরা পৌঁছে ফ্রেশ হয়েই বের হয়ে গেলাম। রাজ পাড়া তে গরম গরম মিষ্টি খাব বলে। সেখানে একদম চুলো থেকে উঠিয়ে আমাদের মিষ্টি দেয়া হল। সেখান থেকে গেলাম , রাজশাহীর টি বাধ এলাকায় । অন্ধকার থাকলেও উপরে প্রচুর তারা ছিল। আমাদের ঠিক বিপরিতেই নদীর ওপারে ভারতের বাড়ি ঘরের বাতি দেখা যাচ্ছিলো। তখন ছিল প্রচুর বাতাস। বন্ধুরা সবাই গান ধরল, আবার এল যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে..…।
রাত ১০ টার দিকে গেলাম উপশহরে শিক কাবাবের বার্গার খেতে। উফফ কি যে মজা ছিল! ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। বার্গার গুলো দেখতেও খুব আকর্ষণীও ছিল।
রাজশাহীর বিখ্যাত কালাই রুটি
এরপর সেখান থেকে উপশহরের কালাই হাউজে গেলাম কালাই রুটি খেতে, প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল। হাসের মাংস, বেগুন ভাজা ও কাচা মরিচের সালাদ, এত ঝাল হবে ভাবতেই পারিনি। ঝালের তীব্রতায় ঘাম ঝরে গেল। এরপর সময় নষ্ট না করে হোটেলে গিয়ে ঘুমাতে গেলাম। এর মাঝে আবার আসিফের কাজিন নেহাল এই হোটেল নিয়ে কিছু ভৌতিক গল্পও বলল। যেগুলো আমি বিশ্বাস করিনা দেখে আপনাদের সাথেও শেয়ার করলাম না ।
পরদিন সকালে উঠে রওয়ানা হলাম বর্ডারের উদ্দেশ্যে। দুপুরের কিছু আগে পৌছালাম বর্ডারের কাছেই সোনা মসজিদে। অসম্ভব সুন্দর এক জায়গা। সেখানে জোহরের নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হল। বর্ডারে দেখার আসলে কিছুই নেই। আগে কিছু দোকানপাট থাকলেও করোনার জন্য যেহেতু বর্ডারে ট্যুরিস্ট আসা বন্ধ তাই, দোকান গুলো ও বন্ধ।
প্রাচীন বাংলার প্রথম মাদ্রাসা
সেখান থেকে গেলাম আমরা চল্লিশ ঘর মাদ্রাসা বা দারাসবাড়ি মাদ্রাসা তে। এটা নাকি প্রাচীন বাংলার প্রথম মাদ্রাসা। এই ব্যাপারে ইন্টারনেটেও একটু ঘাটাঘাটি করে এমন টাই পেলাম। এটা ৩৫/৪০ বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। আগে মাটির নিচে ছিল এটা। কোন এক নকশায় এটার সন্ধান পেয়ে মাটি খুরে এটাকে আবিস্কার করা হয়।
এরপর তার কাছেই ছিল দারাস বাড়ি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। সেখানে গিয়েও এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। কি সুন্দর কারুকাজ করা মসজিদ। কিন্তু একটা মানুষ ও নেই এগুলো রক্ষনাবেক্ষন করার জন্য। এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সুন্দর নিদর্শন গুলো।
তারপর আমরা রাজশাহীর জন্য রওয়ানা দেই। পথে নেহালের এর জোরাজুরিতে লাঞ্চ করতে থামি গোদাগাড়ী নামের এক জায়গায় ট্রাক ড্রাইভার দের এক হোটেলে। কি যে সুস্বাদু খাবার ছিল। না খেলে বোঝা মুশকিল। আর খাবারের আইটেম দেখলে অবাক লাগে। ৩/৪ রকমের গরুর মাংস, ৩ রকমের মুরগি, কবুতর, বিভিন্ন ভর্তা, ভাজি আরও কত কি।
খেয়ে আমরা যাই টি বাধে পূর্ণিমা দেখতে। সেখানে প্রচন্ড বাতাসে শরীর যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। সেখান থেকে হোটেলে এসে, হোটেলের রেস্টুরেন্টে অর্ডার দেই বারবি কিউ করার জন্য। তারা ১ ঘন্টার মধ্যেই সব রেডি করে রুমে পাঠিয়ে দেয়। আমরা আর সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে যাই ।
পরদিন সকালে আমরা হোটেল ছেড়ে দিয়ে, নেহালের বাসায় যাই। সেখানে আন্টি আমাদের দুপুরের খাবারের জন্য দাওয়াত দিয়েছিলেন। রাজশাহীর কালাই এর ডাল, গরুর মাংস, করলা ভাজি। এক কথা অসাধারন। খুবই ভালো লেগেছিল আন্টির হাতের রান্না। এরপর রাজশাহী ভ্রমনের অভিজ্ঞতা এর স্মৃতি নিয়ে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেই ।
রাজশাহী ভ্রমনের অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ
প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হতে বিরত থাকবেন। পরিবেশ কে সুস্থ না রাখতে পারলে আমরাও সুস্থ থাকতে পারব না। এবং দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলোকে দেখভালের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ কামনা করছি।