ভারত ভ্রমণ কাহিনী

পেহেলগাম ভ্রমণ কাহিনী | কাশ্মীর ভ্রমণ -পর্ব ৬

Loading

পেহেলগাম ভ্রমণ

পেহেলগাম বা প্যাহেলগাম (Pahalgam) ভারতের জন্মু এন্ড কাশ্মীর এলাকার অনন্তনাগ জেলার এক পর্যটন শহর। এটি শ্রীনগর থেকে প্রায় ১০০ কিঃমিঃ দূরে লিডার নদীর তীরে অবস্থিত। এর গড় উচ্চতা প্রায় ৭,২০০ ফুট। এটি খুবই জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট এংব হিল স্টেশন। নদী-উপত্যকাশোভিত, নয়নাবিরাম সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভুমি হচ্ছে এই পেহেলগাম। অনেকেই একে বলে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড। আসুন শুনি আমার পেহেলগাম ভ্রমণ কাহিনী।

পেহেলগাম এর দর্শনীয় স্থানসমূহ

পেহেলগাম এ দেখার মত বেশ কিছ সুন্দর সুন্দর স্থান রয়েছে। তার মধ্যে উলেখযোগ্য হলো: মিনি সুইজারল্যান্ড খ্যাত বাইসারান, লিডার নদী, পেহেলগাম ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, আরু ভ্যালি, তুলিয়ান ভ্যালী, পেহেলগাম ভিউপয়েন্ট, কাশ্মীর ভ্যালী ভিউপয়েন্ট, চন্দনওয়ারী, কানিমার্গ, ওয়াটারফল, ধাবিয়ান, মামলেশ্বর মন্দির, কোলাহাই হিমবাহ ইত্যাদি। পেহেলগাম ভ্রমণ এর অংশ হিসাবে সবগুলা স্পট দেখতে হলে ২-৩ দিন সময় লেগে যাবে। হাতে সময় কম থাকায় আমাদের সব গুলো কভার করা সম্ভব হবেনা।

লিডার নদী

সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮। কাল রাতে আমরা সোনমার্গ থেকে পেহেলগাম এসেছি। আমরা এখানে লিডার নদীর পারে এক কর্টেজে উঠেছি। লিডার কাশ্মীরের এক পাহাড়ি নদী। এটি কোলাহাই হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে জেহলাম নদীতে গিয়ে মিশেছে। এর দৈর্ঘ প্রায় ৭৩ কিঃমিঃ। এই লিডার ভ্যালি তেই পেহেলগাম। রাতে আসায় আশেপাশের কিছু দেখতে পারিনাই। শুধু লিডার নদীর তীব্র গর্জন শুনেছি।

সকালে উঠে পর্দা সরিয়ে বাহিরে তাকিয়ে পুরাই অবাক। সামনের ভিউ অসাধারণ। কর্টেজের সামনে ছোট বাগান, যেখানে কিছু চেয়ার দেয়া আছে বসে চা নাস্তা খাবার জন্য। বাগানের জাস্ট নিচেই লিডার নদী যার পানি স্বচ্ছ নীল। নদীতে নামার জন্য সিঁড়ি দেয়া আছে। আমাদের কর্টেজ দারুন সুন্দর। তিনতলা কর্টেজের ফ্লোর, সিঁড়ি, ডেকোরেশন সব কিছু কাঠের। পুরা কর্টেজে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই।

আমরা ব্রাশ, পেস্ট নিয়ে নদীতে চলে গেলাম । নদী একটু আগে থেকে দুই ভাগ হয়ে আমাদের কর্টেজের কাছে এসে আবার মিশেছে। নদীর কনকনে ঠান্ডা পানি দিয়েই আমরা ফ্রেশ হলাম। এখান থেকে নদীর গর্জন আরো বেশি। সেখানে কিছু ছবি তুলে রুমে এসে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। কর্টেজ কতৃপক্ষ আমাদের নাস্তা দিলো। নাস্তা খেয়ে ব্যাগ নিয়ে সবাই নিচে চলে আসলাম।

ঘোড়ার পিঠে চড়া

নাস্তা শেষ করে এসেই দেখি আমাদের ঘোড়া রেডি। ছয় জনের ছয় ঘোড়া। সাইজে বেশ বড়। প্রতি ঘোড়া সারাদিনের জন্য ১৫০০ রুপি। রাতে বলে রাখায় কর্টেজ কতৃপক্ষই ঘোড়া ঠিক করে দেয়। এই ঘোড়ার দাম নিয়ে অনেক কিছু হয়। তাই দরদাম করেই ঘোড়া ঠিক করবেন। আজ সারাদিন আমরা এই ঘোড়া দিয়েই পুরো পেহেলগাম ভ্রমণ করবো। পেহেলগাম ভ্রমণ এর এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

পেহেলগাম ভ্রমণ এর ৬ পয়েন্ট

আমাদের হাতে যেহেতু সময় কম তাই আমরা কেবল ৬-৭ স্পট দেখব। এই স্পট গুলোর উপর ঘোড়ার ভাড়া নির্ভর করে এবং তা একেক মৌসুমে একেক রকম হয়। এইট স্পট নিয়েই এরা আসলে ধান্দা করে। ঘোড়ার রেট বলবে ৩ স্পট এতো ভাড়া, ৪ স্পট এতো , ৭ স্পট এতো ইত্যাদি ইত্যাদি। যাই হোক আমরা পেহেলগামের ৬ স্পট দেখার জন্য ১৫০০ রুপি করে একেক ঘোড়া ভাড়া করলাম।

আমাদের স্পট গুলো হলো পেহেলগাম ভিউপয়েন্ট, কাশ্মীর ভ্যালী ভিউ পয়েন্ট, ধাবিয়ান, বাইসারান, কানিমার্গ, ওয়াটারফল। ৬ ঘোড়ার সাথে আজও দুই এসিস্ট্যান্ট। আগেরদিন সোনমার্গে ঘোড়ায় চড়ে আমরা সবাই মোটামোটি অভিজ্ঞ হয়ে গেছি। তবে যথারীতি খাদেম ভাই আজও ভয়ে আছে। আমরা ওনাকে অভয় দিলাম এবং একজন এসিস্ট্যান্ট কে সর্বদা ওনার কাছাকাছি থাকার জন্য বললাম। সকালে ৯:৩০ এর দিকে আমরা ঘোড়ায় চড়ে পেহেলগাম ভ্রমণে বের হলাম।

আমরা আঁকাবাঁকা পাথরে পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছি। সারি সারি পাইনের বাগান, নিচে লিডার নদী। কখনো কখনো বনের ভিতর দিয়ে আমরা চলেছি। ছোটবেলায় টিভিতে দেখতাম পাইনের বনের ভিতর দিতে ঘোড়া চালিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে রবিন হুড। তখন নিজেকে রবিন হুডের মতোই মনে হচ্ছিলো।

আমরা প্রথমে আসলাম পেহেলগাম ভিউপয়েন্ট। এখন থেকে নিচে পেহেলগাম পুরাটা দেখা যায়। চারিদিকে সব কিছু সবুজ। মাঝে মাঝে কিছু বাড়িঘর, নদী এক কোথায় চমৎকার।

এর পরে আসলাম কাশ্মীর ভ্যালী ভিউ পয়েন্ট। এখন থেকে কাশ্মীর ভ্যালী পুরাটা দেখা যায়। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, মাঝখানে সবুজ সমতল ভূমি। পূর্বে একসময় যখন রাস্তা ছিলোনা তখন নাকি লোকজন ডানপাশের এই উঁচু পাহাড় পায়ে হেটে পাড়ি দিয়েই শ্রীনগর যেত। এমনটাই জানালো দুই এসিস্ট্যান্ট। এখানে কিছু ছবি তুলে আবার আগানো শুরু করলাম।

মিনি সুইজারল্যান্ড বা বাইসারান

এর পর আমরা চলে আসলাম বাইসারান, যাকে সবাই বলে মিনি সুইজারল্যান্ড। টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে ঢুকেই মাথা পুরা নষ্ট। এতদিন ক্যালেন্ডার এ যেমন ছবি দেখতাম অবিকল তেমন। ঘন পাইনের বনের ভিতর অনেক বড় ফাঁকা জায়গা।

পুরাটাই সবুজ, যেন কার্পেট বিছানো। জায়গাটা পুরা সমতল না, মাঝে মাঝে হালকা কিছু কার্ভ আছে। দূরে পাহাড়ের মাথায় সাদা সাদা বফর জমে আছে। সুইজারল্যান্ডে সাধারণত এমন দৃশ্য দেখা যায়। এই জন্যই হয়তো একে বলে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড। আমি সবুজ ঘায়ে কিছুক্ষন গড়াগড়ি করলাম।

এখানে তেমন বেশি হকার নাই। ২-১ জন আছে যারা কাশ্মীরি জামাকাপড় বিক্রি করে। তাদের ই একজন আমাদের বাজরাঙ্গী ভাইজান মুভিতে সালমান খান যে সাদাকালো চাদর পড়েছিল ওটা নেয়ার জন্য অনেক চাপাচাপি করলো। কিন্তু আমরা নিলাম না।

দুই লোক আবার খরগোস, বানর, কবুতর ইত্যাদি প্রাণী নিয়ে এসেছে। আমরা সেগুলা হাতে নিয়ে ছবি তুললাম। তাদের ১০ রুপি করে দিয়ে দিলাম, কিছু বল্লোনা, মনে হলো খুশিই হলো। আমাদের দেশে হলেতো নির্ঘাত ১০০-২০০ টাকা দেয়া লাগতো। এদের চাহিদা অনেক কম। এটা খুব ভালো লাগলো।

জর্বিং

এখানে জর্বিং খেলা যায়। বিশাল এক বলের ভিতর দুইজনকে বেঁধে ঢালু জমিতে ছেড়ে দেয়। আর ওটা গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে থাকে। অন্যরা কেউ সাহস করলোনা। আমি আর আজিজ ভাই সাহস করে উঠে পড়লাম। ১৫০ রুপি করে টিকেট নিলো। প্রথেম একটু ভয় পেলেও পরে দারুন মজা পাইছি। তবে এখানে উঠার জন্য ওজন ৮০ কেজির ভিতরে থাকা লাগে।

জিপ লাইনিং

এখানে জিপ লাইনিং করার ব্যবস্থা আছে। দুই পাশে দুই গাছের সাথে একটি সরু তার বাধা, মানুষেকে ওই তারের সাথে রশি দিয়ে আটকিয়ে ছেড়ে দেয়। আর তারা তাদের দেহের ভারে সামনে এগিয়ে চলে। আমরা দামাদামি করে প্রতিজন ২০০ রুপি করে টিকেট কেটে এটাও উঠে পড়ি। তেমন উঁচুতে না হলেও দারুন মজা পাইছিলাম। আমার লাইফে এটাই প্রথম জিপ লাইনিং করা।

ওয়াটারফল

এর পর আমরা গেলাম ওয়াটারফল। বিশাল বড় ওয়াটারফল। অনেক দূর থেকে রাশি রাশি পানি পাথরের ভিতর দিয়ে প্রচন্ড বেগে গড়িয়ে পড়ছে। তীব্র তার শব্দ। অন্য সময় নাকি আরো বেশি পানি থাকে। আমরা ওয়াটারফল এর মাঝ খানে চলে যাই। জলপ্রপাতের জলে হাত মুখ ধুই।

স্থানীয় প্রশাসন এখানকার জল পাইপ দিয়ে নিচে নিয়ে গেছে যাতে স্থানীয় লোকজন ব্যবহার করতে পারে। ব্যাপারটা দারুন লাগলো। বেশ কিছু ছবি তুলে আমরা আবার সামনে এগিয়ে চলি। ফেরার পথে বাকি স্পট গুলো দেখে আমরা আবার শহরে ফেরত আসি। একটা রেস্টুরেন্ট এ লাঞ্চ করে রওনা দিলাম আপেল গার্ডেন দেখার জন্য।

আপেল বাগান পেহেলগাম

লিডার নদীর পাস দিয়ে ছুটে চলেছি। সামনে আসলো সারি সারি আপেল বাগান। আমরা বড় একটা দেখে গাড়ি থামাই। ড্রাইভার গিয়ে কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে নিলো। তাদের অনুমতি নিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। সব গাছে প্রচুর আপেল ধরেছে। কোন গাছে লাল, কোনো গাছে সবুজ।

সেপ্টেম্বর মাসেই আপেল পরিপূর্ণ হয়। লোকজনকে দেখলাম আপেল পেরে প্যাক করছে। এগুলা এর পর চলে যাবে দুনিয়ার নানা প্রান্তে। আমি আপেল গাছে উঠে পড়ি। এতদিন আম, জাম গাছে উঠলেও এই প্রথম চোখ দিয়ে আপেল গার্ডেন দেখলাম, আবার আপেলের গাছেও উঠলাম।

এখানে আপেল বাগানে প্রবেশ করতে কোনো ফি লাগেনা। কেউ যদি আপেল কিনে তাহলেই তাদের লাভ। আমরা আপেল বাগানে বসে আপেল আর আপেলের জুস খেলাম। জুস্ ৪০ রুপি করে দাম নিল। আপেল বাগানে বসে আপেলের জুস ব্যাপারটা অন্যরকম। আর জুসের টেস্ট ও দারুন।

এখানকার আপেল আর দেশে কেনা আপেলে মাঝে টেস্টে বিস্তর ফারাক। ফেরার পথে বাগান থেকেই বাসার জন্য ৬ কেজি আপেল কিনে নিলাম। ওনারাই একটা পকেটে প্যাক করে দিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হোটেলে এনে মেপে দেখি বেটা ৪ কেজি দিছে। আপনারা আপেল কিনতে চাইলে অবশ্যই ওজন দিয়ে নিবেন। নাহলে ঠকবেন।

পেহেলগাম ভ্রমণ শেষে

আর এভাবেই শেষ হয় আমাদের পেহেলগাম ভ্রমণ। পেহেলগাম ভ্রমণ শেষে আমরা শ্রীনগর চলে যাই। আজ রাতে সেখানেই থাকার প্ল্যান আছে।

অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:

সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।

3.7 3 ভোট
রেটিং

লেখক

Rashedul Alam; Rasadul Alam; founder of cybarlab.com; founder of trippainter.com; trippainter.com; cybarlab.com; Bangladeshi travel blogger; Bangladeshi blogger; Bangladeshi software engineer

আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।

Subscribe
Notify of
2 মন্তব্য
Inline Feedbacks
সব মন্তব্য দেখুন

''

2
0
আমরা আপনার অভিমত আশা করি, দয়াকরে মন্তব্য করুনx