পানাম নগর বা পানাম সিটি (Panam City) বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর। বাংলার বার ভূঁইয়াদের সর্দার ঈশা খাঁ ১৫ শতকে সোনারগাঁয়ে বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। সোনারগাঁয়ের প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠে এই নগরী। প্রাচীন সোনারগাঁযের (বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর) তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সুন্দর।
পানাম সিটি কোথায় অবস্থিত
পামান নগরী বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত। এটি ঢাকা – চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মেঘনা ব্রিজের কাছাকাছি মোগরাপাড়া বাস স্টেশন এর কাছে অবস্থিত। রাজধানী ঢাকা শহর থেকে এর দুরুত্ব প্রায় ২৫ কিঃমিঃ। সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প যাদুঘর থেকে উত্তর দিকে প্রায় এক কিঃমিঃ দূরেই পানাম নগর।
পানাম নগরীর নির্মাণশৈলী
পানাম নগরীর বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণশৈলীতে রয়েছে অপূর্ব কারুকার্য ও অভিজাত্যের ছোঁয়া। বাড়ি গুলোর স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মোঘল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। নগরীর ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার দুই পাশে ৫২ টি বাড়ি এখনো টিকে আছে।
রাস্তার উত্তর দিকে আছে ৩১ টি বাড়ি এবং দক্ষিণ দিকে আছে ২১ বাড়ি । এই বাড়ি গুলোর কোনটি এক তলা, কোনটি আবার দুই বা তিন তলা। নগরীর ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, মঠ, নাচঘর, গোসলখানা, চিত্রশালা, পান্থশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর ইত্যাদি। এছাড়া আছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরোন টাঁকশাল বাড়ি।
পানাম নগরীর চার্ দিকে আছে পঙ্খীরাজ খাল। এই পঙ্খীরাজ খাল মেনিখালী নদ নামে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। পানাম নগরীর পূর্ব দিকে রয়েছে মেঘনা নদী আর পশ্চিম দিকে শীতলক্ষ্যা। এই নদী পথেই একসময় মসলিন রপ্তানি হত।
পানাম নগরীর পরিকল্পনাও ছিল দারুন। নগরীতে পানি সরবাহের জন্য এর দুই পাশে রয়েছে ২টি খাল ও ৫টি পুকুর। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কুয়া। বৃষ্টির পানি যাতে না জমে থাকে এর জন্য একে খালের দিকে একটু ঢালু রাখা হয়েছে। প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে একটু দূরত্বে অবস্থান করছে। নগরীরতে চলাচল করার জন্য এর মাঝখান দিয়ে আছে রাস্তা। পানাম নগরীর প্রবেশ পথে আছে বিশাল গেট। সূর্যাস্থের সাথে সাথে এই গেট বন্ধ করে দেয়া হতো।
নির্মাণ সময়
ধারণা করা হয় ১৫ শতকে পানাম নগরী স্থাপিত হয়েছিল। এর পর থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ পানাম নগরীকে সম্মৃদ্ধ করেছে। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের তৈরি বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০ টি ঐতিহাসিক শহরের তালিকায় পানাম নগর এর নাম স্থান পায়।
পানাম সিটি তে আর কি কি দেখবেন
পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে সময় কাটানোর জন্য পানাম নগরী আদর্শ জায়গা। তার পরেও এর জন্য ১-২ ঘন্টা সময়ই যথেষ্ট। তাই আশেপাশের ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন আরো কিছু স্থাপনা গুলোতে ঘুরে আসতে পারেন। পানাম নগরী থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই আছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, যা সোনারগাঁ যাদুঘর নামে পরিচিত।
সোনারগাঁ জাদুঘর থেকে পশ্চিম দিকে রয়েছে গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ। এ মসজিদটি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর শাসনামলে ১৫১৯ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। অটো বা রিকশা করে যেতে পারেন। ভাড়া নিবে ২০ থেকে ২৫ টাকা।
আরো দেখতে পারেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীলচাষের নীলকুঠি, যা পানাম পুলের কাছে দুলালপুর সড়কের পাশেই অবস্থিত। হাতে সময় থাকলে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা দিয়ে একটু দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন আরো কিছু ইমারত, বারো আউলিয়ার মাজার, হযরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তাঁর বংশধরদের মাজার ইত্যাদি।
দেখতে পারেন দমদমদুর্গ যা দমদম গ্রামে অবস্থিত। এছাড়াও পানাম নগরীর আশেপাশে আছে ঈসা খাঁ ও তাঁর ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীরের মাজার, ফতেহ শাহের মসজিদ, কদম রসুল, চিলেকোঠাসহ বহু পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ববহ স্থাপনা। সময় থাকলে সেগুলো দেখে যেতে পারেন।
পানাম সিটি কিভাবে যাবেন
পানাম নগর যেতে হলে আপনাকে ঢাকা – চট্টগ্রাম মহাসড়কের ধরে মেঘনা ব্রিজের কাছাকাছি মোগরাপাড়া বাস স্টেশনে আসতে হবে। সেখান থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূরেই পানাম সিটি। সব থেকে ভালো হয় প্রাইভেট কার নিয়ে গেলে। তাহলে আশেপাশের সব কিছু ভালো করে দেখা যাবে।
এছাড়া ঢাকা থেকে বাস দিয়েও যাওয়া যায়। এতে খরচ বেশ কম হয়। গুলিস্থান থেকে বেশ কিছু বাস ছাড়ে যেগুলা দিয়ে সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া বাসষ্ট্যান্ড যাওয়া যায়। বাস ভাড়া সার্ভিসভেদে ২৫-৫০ টাকা। সময় নিবে এক থেকে দেড় ঘন্টা। মোগড়াপাড়া হতে রিক্সা/অটোরিক্সা যোগে পৌঁছে যাবেন পানাম নগর। ভাড়া নিবে ১০-২০ টাকা। তবে ইচ্ছা করলে প্রথমে পাশের সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর ঘুরে, পরে হেঁটেই চলে যেতে পারেন পানাম নগর।
প্রবেশ ফি
পানাম নগরে প্রবেশ করতে হলে টিকেট কাটা লাগে। টিকেটের মূল্য জন প্রতি ৩০ টাকা। সামনেই গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা আছে।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
এছাড়া সময় থাকলে এর কাছাকাছি আরো কিছু স্থান দেখতে পারেন :
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।