পুনাখা শহর (Punakha City) ভুটানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কেন্দ্র। এই শহর এক সময় ভুটানের রাজধানী ছিল। পুনাখা শহর ভ্রমণ করে আজ আমি আপনাদের আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবো।
পুনাখা শহর ভ্রমণ
নভেম্বর ২৪, ২০১৭ সকাল ১১:০০, ভুটানে আজ আমাদের তৃতীয় দিন। দোচুলা পাস থেকে আমরা আবার পুনাখার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। সেই একই দৃশ্য। বড় বড় পাহাড়, নানা প্রজাতির বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, ফুল, পাখি, ঝরনা, পাহাড়ী নদীর কলতান। সাপের মতো সরু বাঁকা পথ ধরে চলছি ভুটানের প্রশাসনিক শহর পুনাখার দিকে।
মিনচুনা ফলস্
কিছুক্ষন চলার পরেই চোখে পড়লো অপূর্ব সুন্দর এক জলপ্রপাত, নাম মিনচুনা ফলস্। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম। জলপ্রপাত এর শীতল জলে মুখ ধুলাম, ছবি তুললাম। জলটা অবশ্য সেই ঠান্ডা ছিল।ছবি তুলতে যেয়ে শাহিদ ভাইয়ের চশমা পরে গেলো পানিতে। অনেক কষ্ঠে তুলা হলো।
দেখলাম বিভিন্ন যানবাহনের চালকেরা এখানে গাড়ি থামিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছে, খাবার পানি নিচ্ছে। ঝর্ণার পানি খেতে সেই টেস্টি। আমরাও খেলাম। সবাই বোতলে পানি নিয়ে নিলাম। আবার শুরু হলো আমাদের পথ চলা। এই রকম ছোট ছোট ঝর্ণা, ঝিরি পুরা পথ জুড়েই দেখা গেল। আশেপাশের সবাই এগুলা থেকেই দরকারি পানি নেয়। আহ আমাদের দেশে যদি এমন থাকতো!
পুনাখার দর্শনীয় স্থান
পুনাখাতে পুনাখা শহর ছাড়াও এর আশেপাশে আছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। মো চু নদী, ফো চু নদী, পুনাখা জং, পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ, লোকাল মার্কেট, প্রায় ১ হাজার ফুট উচ্চতায় খামসুওয়ালে মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম।
পুনাখা শহর
দোচুলা থেকে পুনাখা শহরের দূরত্ব মাত্র ৪১ কিলোমিটার। কিন্তু আঁকাবাঁকা পথের কারণে এই অল্প দূরত্ব অতিক্রম করতেই অনেক সময় লেগে যায়। দুপুর ১ টা নাগাত আমরা পুনাখা শহরে চলে আসলাম। পুনাখা (জংখা: ভুটানি ভাষায়) ভূটানের একটি শহর এবং পুনাখা জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র।
১৯৫৫ সল্ পর্যন্ত পুনাখা ভুটানের রাজধানী ছিল। রাজধানী থিম্পু থেকে পুনাখার দুরুত্ব প্রায় ৭২ কিলোমিটার এবং গাড়ি দিয়ে আসতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘন্টার মতো। এটি সমুদ্রতল থেকে ১৩১০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এখানে ধান চাষ করা হয় প্রধান ফসল হিসেবে।
মো চু নদী এবং ফো চু নদী
এই শহরে দুটি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। একটির নাম মো চু আর অন্যটির নাম ফো চু। ভুটানি ভাষায় চু মনে নদী। ভুটানিরা মনে করে মো চু হচ্ছে পুরুষ যার পানি ঘোলা এবং উষ্ণ । আর ফো চু হচ্ছে মেয়ে যার পানি পরিষ্কার এবং শীতল। পুনাখা জং এর কাছে এসে এরা একসাথে মিলিত হয়েছে। দূর থেকে দুই নদীর মিলনস্থল আর পুনাখা জং দৃশ্য অসাধারণ।
আমরা মো চু নদীতে নামলাম, পানি স্পর্শ করলাম। নদীতে প্রচুর পাথর জমে আছে। আমরা সেগুলা নিয়ে ব্যাঙ খেলা করলাম। দারুন লাগলো। আসার সময় অনেকেই পাথর নিয়ে এসেছিলাম স্মৃতি হিসাবে। ভালো কথা, ফো চু নদীতে কিন্তু রাফটিং করা যায়। ৬/৭ হাজার রুপী খরচ হয় । রাফটিং এর জন্য যা যা লাগে সব কিছুই তারা দেয়। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় রাফটিং করতে পারিনাই। আপনার ট্রাই করতে পারেন। অনেক মজার একটা জিনিস। মো চু আর ফো চু নদী কিন্তু শেষে এসে আমাদের বাংলাদেশে মিশেছে।
পুনাখা জং
পুনাখা জং বা পুনাখা ডিজং পুনাখা শহরের এক খুবই প্রাচীন প্রাসাদ। এটি ১৬৩৭-১৬৩৮ নির্মাণ করা হয়। ইউনেস্কো এটাকে ভুটানের ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করেছে। এটি ভূটানের দ্বিতীয় প্রাচীন, বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর প্রাসাদ। রাজধানী থিম্পুতে স্হানান্তরিত হবার আগ পর্যন্ত এটাই ছিলো ভূটানের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র। এখানে রাজ্ পরিবারের সন্তানদের নাম রাখার অনুষ্ঠান হয়।
এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করা যায়। টিকেটের মূল ৩০০ রুপী। দুপুর ১:৩০ থেকে ২:৩০ পর্যন্ত দুপুরের খাবারের জন্য এটি বন্ধ থাকে। আমরা শেষ সময় যাওয়ায় এবং হাতে সময় না থাকায় আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারিনাই। লোক মুখে শুনছি ভিতরটা নাকি অনেক সুন্দর। পরবর্তী সময় গেলে অবশ্যই ভিতরে যাব। আপনারা কিন্তু হাতে সময় নিয়ে যাবেন এবং পুনাখা জং দেখেই আসবেন।
পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ
পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ ভূটানের সব থেকে বড় সাসপেনশন ব্রিজ। এটি ৩৫০ মিটার লম্বা। পুনাখা জং এর সাথেই এই ব্রিজ। এটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৪০১২ ফুট। আমরা মো চু নদী পার হয়ে গাড়ী থেকে নেমে ১২/১৫ মিনিট হাঁটার পরেই ব্রিজটিতে পৌঁছে গেলাম। এমন সুন্দর আর বড় সাসপেনশন ব্রিজ আমি আগে আর দেখি নাই।
আমরা দৌড়ে ব্রিজে চলে গেলাম। ব্রিজের উপর থেকে নিচের সব কিছু অনেক ছোট মনে হচ্ছে। ব্রিজ থেকে পুনাখার আসে পাশের দৃশ্য দেখতে অনেক চমৎকার। ফো চু নদীর পানি অন্যরকম কালারফুল। অনেককেই দেখলাম নদীতে রাফটিং করছে। আমরা প্রচুর ছবি তুললাম।
আমরা হেটে হেটে ব্রিজের অপর প্রান্তে চলে গেলাম। অপর পাশে কিছু পরিবার থাকে। তাদের সাথে কথা বললাম। পায়ে হেটে আমরা ব্রিজের নিচে নদীর কাছে গেলাম এবং নদীর পাশ ধরে কিছুক্ষন হাটলাম। পরে আবার ব্রিজ পার হয়ে মূল শহরে চলে আসি।
পুনাখা শহর ভ্রমণ শেষে
এই পুনাখা শহর খুবই ছোট। আমরা কিছুক্ষন শহরে ঘুরাঘুরি করে আবার একই পথে থিম্পুর উদ্দেশে যাত্রা করি। সন্ধ্যার পর পর চলে আসি থিম্পুতে। আপনারা চাইলে পুনাখায় এক রাত থাকতে পারেন। খুব সকালে এখানকার হোটেলে মেঘ চলে আসে। ওটা নাকি দেখতে অন্য রকম লাগে।
অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:
- পর্ব ১: সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণ
- পর্ব ২: থিম্পু শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৩: দোচুলা পাস ভ্রমণ
- পর্ব ৪: পুনাখা শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৫: চেলে লা পাস ভ্রমণ
- পর্ব ৬: পারো শহর ভ্রমণ
- পর্ব ৭: ভুটান ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরা
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।