শিলিগুড়ি (Siliguri) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের এক শহর এবং পর্যটন কেন্দ্র। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। এই শহর থেকেই দার্জিলিং, সিকিম যেতে হয়।
আমরা ভুটান থেকে এসেছি। হাসিমারা থেকে ট্রেনে শিলিগুড়ি যাবো। শিলিগুড়ি শহরে একদিন থেকে পরে শিলিগুড়ি থেকে সড়ক পথে ঢাকা যাবো।
হাসিমারা টু শিলিগুড়ি
দুপুর দুইটার দিকে আমরা চলে আসি ইন্ডিয়ার হাসিমারা রেলস্টেশনে (Hasimara Railway Station)। এটি পশ্চিম বঙ্গের আলিপুর দুয়ার জেলার হাসিমারা গ্রামে অবস্থিত। রেলস্টেশন টি বেশ বড়। আর সব ধরণের নাগরিক সুবিধাই রয়েছে। এখান থেকে ইন্ডিয়ার যেকোন জায়গার যাওয়া যায়।
এখানে বাংলাদেশের এক পরিবারের সাথে দেখা হল। তাদের বাড়ি যশোর। তারাও আমাদের মতো ভিডিও দেখে সড়ক পথে ভুটান ভ্রমণে এসেছে। তারা এখান থেকে প্রথমে ট্রেনে কলকাতা, পরে বেনাপোল হয়ে দেশে যাবে। আমরা শিলিগুঁড়ির ৬ টা টিকেট কেটে নেই। প্রতি টিকেটের মূল্য নিল ৬০ রুপী।
আমাদের ট্রেন বিকাল ৫ টায়। এখন থেকে শিলিগুঁড়ির যেতে প্রায় ২ ঘন্টা লাগবে। আপনারা যারা ট্রেনে চলাচল করতে আগ্রহী তারা কলকাতা বা চ্যাংড়াবান্ধা থেকে এখানে এসেই নামবেন। পরে টেক্সিতে ইন্ডিয়া-ভুটান বর্ডার।
ট্রাক স্ট্যান্ড এ লাঞ্চ
হাতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় রয়েছে, আর খিদে পেয়েছে প্রচুর। তাই তাড়াতাড়ি চলে যাই রেলস্টেশন এর পাশে ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট বা হোটেলের খুঁজে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই এক ভাতের হোটেল। হোটেল টি ট্রাক স্ট্যান্ড এর পাশেই অবস্থিত। ড্রাইভার – হেলপাররা এসে খবু মজা করে খাচ্ছে।
আমরা ভাত আর মুরগির মাংসের অর্ডার করি। ভাত শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা আবার চুলায় রান্না বসায়। ট্রেডিশনাল মাটির চুলা, লাকড়ি দিয়ে রান্না চলে। ১৫-২০ মিনিটের ভিতরেই ভাত হয়ে যায়। তারা খাবার সার্ভ করে। কি আর বলব, ৫-৬ দিন যাবত চোঁখে ভাত দেখিনা। আর কি সব অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে মুখ পুরা শেষ। তাই সবাই ঝাপাইয়া পড়ি।
প্রথম বার যা দিলো তা মুহূর্তের মাঝেই শেষ। আবার নিলাম। অনেক দিন পর সবাই খুব তৃপ্তি করে খেলাম। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা এটা আমার লাইফের সব থেকে মনে রাখার মতো খাবার, যা এখনো জিভে লেগে আছে। ইন্ডিয়ার এক ট্রাক স্টান্ডে বসে যে খাবার খেলাম তা আজীবন আমাদের সবার মনে থাকবে। খাবার পর বিলও তেমন আসে নাই।
দাদা এতগুলা টাকা গচ্ছা দিবেন
দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চলে আসি রেলস্টেশনে। এসে যা শুনলাম তাতে সবার মাথায় হাত। ট্রেন নাকি ৫ ঘন্টা দেরি হবে!! প্ল্যান প্রোগ্রাম সব ভেস্তে গেল। এতক্ষন অপেক্ষা করা যাবেনা। তাই টিকেট ফেরত দিয়ে বাসেই শিলিগুঁড়ি যাবো সিদ্ধান্ত নেই। ৬ টিকেট ফেরত দিতে চাই শুনে টিকেট মাস্টার আকাশ থেকে পরে। বলে দাদা এতগুলা টাকা গচ্ছা দিবেন!! একটু দেরি করলেই তো পারেন। টিকেট ফেরত দিলে তারা ৫০% কেটে রাখে। কি আর করা, লস দিয়েই টিকেট ফেরত দিলাম।
সিনেমার অভিজ্ঞতা
স্টেশন এর কাছে সেই ভাতের হোটেলের পাশে দিয়েই বাস যায়। আমরা সেখানে বাসের জন্য দাঁড়াই। অনেক্ষন পরেও কোনো বাস আসলোনা। ভাতের হোটেলের লোকেরা বললো এখন প্রায় ৫ টা বেজে গেছে, ২ টার পরে আর কোনো বাস ছাড়েনা। আজ আর কোনো বাস পাবার সম্ভবনা নাই। শুনে তো আবারো মাথায় হাত, বলে কি!!
প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে গেলে অনেক রুপী লেগে যাবে। এইদিকে কারো কাছে তেমন মাল পানি নাই। যা আছে তা দিয়ে কিছু শপিং করার প্ল্যান আছে। নায়ক/নায়িকা ট্রেন মিস করে, পরবর্তী কয়েকদিন আর কোনো ট্রেন নাই, এমন কাহিনী সাধারণত সিনেমায় দেখা যায়। কিন্তু তার সাথে আমাদের মিলে যাবে তা কখনো ভাবিনাই।
এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, আসে পাশে থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থাও নাই। আমাদের অবস্থা করুন। মনে মনে ভাবতে থাকি আজ বুজি ট্রাকের সাদে করেই যেতে হবে।
শিলিগুড়ি যাবার বাস
এই যখন অবস্থা তখনই দেখি বড় এক বাস আসতাছে। হাত তুলতেই থেমে গেল। দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা এই বাস কি শিলিগুঁড়ি যাবে। বললো যাবে, ১০০ রুপী করে লাগবে। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি। উঠেই দেখি বাসে ড্রাইভার, হেল্পার ছাড়া আর কেউ নাই। মনের ভিতর ভয় ঢুকে গেল। মাজ রাস্তায় পিস্তল বের করে সব কিছু রেখে যদি নামায় দেয়।
আমি বসে বসে তাদের গতিবিধি মনিটর করতে থাকি। উল্টা পাল্টা কিছু দেখলেই যাতে প্রতিরোধ করতে পারি তার প্ল্যান করতে থাকি। সবুজ মাঠের ভিতর দিয়ে বাস দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলে। বাসটি অন্যরকম, দুইতলা, উপরে শোবার ব্যবস্থা আছে। ঢাকায় ডাবল ডেকার বাস দেখিছি, উঠেছি। সেখানে বসে ঘুমানো গেলেও শোবার ব্যবস্থা নাই।
একটু পর হেল্পার কে জিজ্ঞেস করলাম, বাসে আর কোনো যাত্রী নাই কেন? বললো আমাদের একটি বাস নষ্ট হয়ে গেছে, ওটার রিপ্লেসমেন্টে এটা যাচ্ছে।
সামনে থেকে এক বয়স্ক মহিলা আর তার ছেলে উঠল। উঠেই মহিলাটি সিঁড়ি দিয়ে সোজা দোতালায় যেয়ে সুন্দর ভাবে শোয়ে পড়ল। ব্যাপারটা দারুন লাগল। আহঃ ঢাকার বাসগুলো যদি এমন হত, তাহলে অফিস থেকে বের হয়েই লম্বা এক ঘুম দিয়ে দিতাম। ২-৪ ঘন্টা যা লাগার লাগুক। তারা আর কোনো যাত্রী উঠালোনা। মাজখানে একবার চা পানের বিরতি দিয়ে বাসটি দ্রুতই শিলিগুঁড়ি চলে আসল। আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
শিলিগুড়ি
বাস থেকে নেমে অটো নিয়ে চলে আসি জংশন মোড়। খুজাখুজি করে এক রাতের জন্য ১৩০০ রুপী দিয়ে হোটেল ভাড়া করে নেই। হোটেলের নাম শ্রীডিপ প্যালেস। হোটেল টি ভালোই। ওয়াইফাই স্পিডও বেশ। আপনারা দেখে, দরদাম করে তবেই রুম ভাড়া নিবেন।
ফ্রেশ হয়ে শপিং করা জন্য চলে যাই এক সুপার শপ এ। সুপার শপটি বিশাল বড়। কিন্তু ১০ টায় শপ বন্ধ হয়ে যায়, তাই তেমন কিছু আর কিনতে পারিনাই। পরে নেতাজি হোটেল নামে এক ভাতের হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে নেই।
হোটেলের রান্না সেই টেস্টি। আমরা বোয়াল মাছ, সবজি আর ভাত খাই। দাম নিল ৮০ রুপী। কথায় কথায় পরিচয় হল, হোটেলের মালিকের আদি বাড়ি আমাদের দেশেই। ৭১ এর পরে চলে গেছে। সবাই খুব ক্লান্ত, তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি।
শিলিগুড়ি বিগ বাজার এ শপিং
দুপুর ৩ টায় আমাদের গাড়ি শিলিগুড়ি থেকে ছেড়েযাবে। আসার সময়ই আমরা শ্যামলী পরিবহনের রিটার্ন টিকেট কেটে আসছিলাম। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পাশেই এক রেস্টুরেন্টে ইন্ডিয়ান খাবার দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। তার পর চলে যাই বিগ বাজারে। বিগ বাজার ইন্ডিয়ার চেইন সুপার শপ। প্রায় প্রত্যেক বড় বড় শহরেই এর ব্রাঞ্চ রয়েছে।
১০ টায় শপ খুললো, আমরা ভিতরে প্রবেশ করি। বিশাল বড় শপ, আকারে আমাদের দেশের সুপার শপ থেকে প্রায় ১০ গুন বড় হবে। আর হিউজ কালেকশন। দাম তুলনামূলক ভাবে আমাদের দেশ থেকে অনেক অনেক কম। এইজন্যই সবাই আমাদের দেশ থেকে ইন্ডিয়া যায় শপিং এর জন্য। মজার ব্যাপার হল কোনো অতিরিক্ত ভ্যাট নেয় না। পণ্যের গায়ে যা দাম লেখা আছে তাই রাখে।
আমরা যার যার সাধ্যমত জিনিসপত্র কিনে নিলাম। আপনারা ইন্ডিয়া গেলে অবশ্যই একবার আসবেন বিগ বাজারে। এখানে শুধু আমাদের দেশের মতো চাল, ডাল না, সব ধরণের জামা কাপড়, কসমেটিক্স, খেলনা, জুতা, ব্যাগ, খাবার আইটেম ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়।
২ টার দিকে বের হয়ে চলে আসি হোটেলে। ব্যাগ নিয়ে চলে যাই শ্যামলী কাউন্টারে। পাশেই এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। সবাই বিরানি খাই। টেস্ট খারাপ না। ৩ টার দিকে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল।
ইমিগ্রেশন এর অভিজ্ঞতা
এই কয়দিনে সকল ধরণের অনিয়ম, চুরি-বাটপারি সবই ভুলে গেছিলাম। কিন্তু বর্ডারে এসেই আবার সব কিছুর দেখা পাইলাম। ৬ তার দিকে আমরা চলে আসি চ্যাংড়াবান্ধা। ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন এর লোকজন তেমন ঝামেলা করলোনা। ব্যাগ হালকা-পাতলা চেক করে ছেড়ে দিল।
ঝামেলা যা করার করলো আমাদের দেশের লোকজন। সবার কাছে থেকে ২০০ করে টাকা নিল ঠিকই কিন্তু এই সেই কত বাহানা। যাই হোক শ্যামলীর যাত্রী বলে একটু রক্ষা পাই। কিন্তু অন্যদের খুব ঝামেলা করল। অবাক লাগে পাশাপাশি দুই দেশের লোক অথচ আচরণে কত তফাৎ। বুড়িমারী বর্ডারেই আমাদের গাড়ি ছিল। আমরা উঠে পড়ি। সকাল ৮ টার দিকে ঢাকায় এসে পৌছাই।
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।