শ্রীনগর (Srinagar) ঝিলম নদীর তীরে অবস্থিত এক পর্যটন শহর। এটি ভারতের জম্মু এন্ড কাশ্মীর এলাকার সব থেকে বড় শহর। এখানকার লেক, হাউসবোট, শিকারা, পাহাড়, সবুজ মাঠ, বার্চ ও উইলো গাছে পূর্ণ অরণ্য পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এখানকার বিভিন্ন কুটির শিল্প, ড্ৰাই ফুডস, মসলা খুবই বিখ্যাত। এজন্যই শ্রীনগর কে বলা হয় প্রাচ্যের ভেনিস। আসুন শুনি আমার শ্রীনগর ভ্রমণ কাহিনী।
শ্রীনগর ভ্রমণ কাহিনী
সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮। আজ সারাদিন আমরা কাশ্মীরের পেহেলগাম ভ্রমণ করেছি। ভ্রমণ শেষে এখন আমরা রাজধানী শ্রীনগরের পথে। শ্রীনগর টু পেহেলগাম সড়ক অসাধারণ সুন্দর। লিডার নদীর পার ঘেসে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। অন্য পাশে সবুজ পাহাড়, সারি সারি আপেল গার্ডেন, নাস্পাতির বাগান। গতকাল রাতে এই পথে পেহেলগাম যাওয়ায় এই অপূর্ব সৌন্দর্য আমরা মিস করেছিলাম।
শ্রীনগরের দর্শনীয় স্থানসমূহ
শ্রীনগরে দেখার মতো বেশ কিছু প্রাকৃতিক, প্রাচীন এবং ঐতিহাসি স্থান রয়েছে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ডাল লেক, নাগিন লেক, নিশাত বাগ, টিউটিল গার্ডেন, শ্রী প্রতাপ সিং মিউজিয়াম, জামা মসজিদ, হজরৎ বল মসজিদ, দচিগাম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ক্রিকেট ব্যাট ফ্যাক্টরি ইত্যাদি। শ্রীনগর ভ্রমণ এর অংশ হিসাবে আমরা সবগুলো স্থানই কভার করার চেষ্টা করবো।
ক্রিকেট ব্যাট ফ্যাক্টরি
শ্রীনগরে প্রচুর ক্রিকেট ব্যাট ফ্যাক্টরি রয়েছে। শ্রীনগর-জম্মু হাইওয়ের পাশে মিলবে এই সকল ক্রিকেট ব্যাট ফ্যাক্টরি। এখানে এরা কাঠ থেকে বিভিন্ন পক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রিকেট ব্যাট তৈরী করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে। শেষ বিকালে এমন এক ব্যাট ফ্যাক্টরির সামনে এসে আমরা থামি।
ড্রাইভারের মুখে গল্প শুনে আমি ভেবেছিলাম এই সকল ফ্যাক্টরি সাইজে হয়ত অনেক বিশাল হবে। কিন্তু এসে দেখি আসলে তেমন না। আমাদের ঢাকা শহরে শেওড়াপাড়া বা নতুনবাজারে যেমন ফার্নিটারের দোকান আছে অনেকটাই তেমন। দোকানের নিচ তলায় ফ্যাক্টরি, দোতালায় অফিস এবং ডিসপ্লে সেন্টার।
নিচতলায় কাঠ কাটার, পালিশ করার এবং কম্প্রেস করার যন্ত্র রয়েছে। ফ্যাক্টরির মালিক মুসলিম এবং বেশ ভালো। অনেক আন্তরিকতার সাথেই ওনি আমাদের কাঠ থেকে কিভাবে বিভিন্ন পক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রিকেট ব্যাট তৈরী করা হয় তা বর্ণনা করলেন এবং হাতে কলমে দেখিয়ে দিলেন।
যেভাবে ক্রিকেট ব্যাট বানায়
তিনি জানালেন প্রথমে ওনারা ক্রিকেট ব্যাটের জন্য বিশেষ এক ধরণের গাছ থেকে ব্যাটের সাইজ মতো কাঠ কেটে নেয়। তার পর হ্যান্ডেল লাগানোর জন্য জায়গা করে কেটে ১ বছর বাহিরে ফেলে রাখে। ১ বছর সেগুলা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে।
তার পর সেগুলাকে এনে প্রেসার মেশিনে প্রেসার দিয়ে কম্প্রেস করে। নরমাল ব্যাটের জন্য ৫ বার, ডিউস বলের জন্য ১০ বার, ওয়ানডে ম্যাচের জন্য ২৫ বার , টেস্ট ম্যাচের জন্য ৫০ বার প্রেসার দেয়। কোনটা ভেঙে গেলে সেখানেই ফেলে দেয়। এর পর হ্যান্ডেল লাগিয়ে পালিশ করে।
এর পর ১ দিন এক ধরণের কেমিক্যাল মিশ্রিত জলের মধ্যে ভিজিয়ে রাখে। তার পর এনে আবার হালকা কিছু প্রেসার দিয়ে পালিশ করে। ফাইনালি অর্ডার অনুসারে স্টিকার লাগিয়ে দেয়। এগুলা এখন সাকিব, কোহেলির হাতে ঝড় তোলার জন্য তৈরী। একটা ক্রিকেট ব্যাট তৈরী করতে এতো সময়, পরিশ্রম এবং প্রসেস লাগে আগে জানা ছিলোনা। আমরা তো খালি দোকানে যেয়ে কিনেই মাঠে চলে যাই।
এখানকার ব্যাটগুলো অনেক সস্তা এবং টিকসই। একটি ভালো মানের ডিউস ব্যাট মাত্র ১০০০-১২০০ রুপি। আমি আমার মেয়ের জন্য ১৭৫ রুপি দিয়ে একটি ব্যাট কিনে নেই। এটা কেমন স্ট্রং তা দেখাবার জন্য তিনি ব্যাটের এক মাথা ইটের উপর রেখে জোরে লাফাতে লাগলেন। আমি বলি ভাই কি করেন, ভেঙে যাবে তো। বললো ভাঙলে আরেকটা দিবো। যাই হোক কিছুই হয় নাই।
কাশ্মীরি ড্ৰাই ফুড
কাশ্মীরের ড্ৰাই ফুড এবং মসলা খুবই বিখ্যাত। আমরা শ্রীনগর-জম্মু হাইওয়ের পাশে এক ড্রাই ফুডের দোকানে যাই। এখানে সড়কের দুই পাশেই প্রচুর ড্রাই ফুডের দোকান রয়েছে। আমরা এখান থেকে জাফরান, বাদাম, খেজুর, ক্যানবেরি, ব্ল্যাকবেরি, আখরোট ইত্যাদি বিভিন্ন ড্ৰাই ফুড কিনে নিলাম। এগুলার দাম কোয়ালিটির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রকম হয়।
এখানে জাফরান খুবই সস্তা এবং উন্নতমানের। আমাদের কাছে প্রতি গ্রাম ২০০ রুপি করে রাখে। আরো কমে পাওয়া যায়, তবে সেগুলার কোয়ালিটি এতো ভালো না। শ্রীনগর-জম্মু হাইওয়ের পাশে প্রচুর জাফরান চাষ হয়। জাফরান ক্ষেত দেখতে দারুন সুন্দর। ড্ৰাই ফুড কেনার আগে সেগুলা অরিজিনাল কিনা যাচাই করে নিবেন।
ডাল লেক শ্রীনগর
কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে অবস্থিত মিঠা পানির এক অপূর্ব সুন্দর লেক হচ্ছে ডাল লেক(Dal Lake)। এর দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার, প্রস্থ সাড়ে তিন কিলোমিটার। লেকের সর্বোচ্চ গভীরতা ছয় কিলোমিটার। এই লেকে দুটি দ্বীপ আছে, সোনা লান্ক আর রূপা লান্ক। শীতকালে লেক এলাকার তাপমাত্রা মাইনাস ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে চলে যায়। লেকের পানি তখন জমে বরফ হয়ে যায়।
এখানে বেশ কিছু হিন্দি মুভির শুটিং হয়েছে। লেককে ঘিরেই কাশ্মীরের হাজারো মানুষ তাদের জীবিকা অর্জন করে। কেউ হাউসবোটের মালিক, কেউ ডাল লেকের বিশেষ নৌকা শিকারাতে পর্যটকদের নিয়ে পরিভ্রমন করে, আবার কেউবা ডাল লেকের বাজারে সবজি বিক্রয় করে।
হাউসবোট
ডাল লেকের প্রধান আকর্ষণ হলো হাউসবোট, পানির উপরে ভাসমান বাড়ি। ডাল লেকে প্রায় ৭০০ মতো হাউসবোট আছে। এগুলার ভিতরে আধুনিক হোটেলের মত নানান সুবিধা রয়েছে। আছে শোবার ঘর, বসার ঘর, বাথরুম, বাথটাব, বারান্দা, ওয়াইফাই ইত্যাদি।
মেঝেতে সুন্দর কার্পেট বিছানো, দরজা-জানালায় পর্দা টানানো। বারান্দায় বসে অনায়াসে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। হাউসবোটের দেয়াল কাঠের তৈরী, যা দারুন ভাবে করুকার্জ করা। মোট কথা এই হাউসবোটে পাওয়া যাবে সবধরনের সুবিধা যা একজন পর্যটকের একান্ত প্রয়োজন।
এই হাউসবোট গুলোর একেকটার একেক ধরণের ভাড়া। আমাদের ড্রাইভারের বাসা ডাল লেকের পারেই। ওনার মাধ্যমে আমরা ভালো মানের একটা হাউসবোট ভাড়া করে নিলাম। ভাড়া পড়লো একেক রুম ১৫০০ রুপি করে। সাধারণত এই রুমের ভাড়া নাকি ৭০০০ রুপি।
পুরা বোটে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। ওয়াইফাই, বাথটাব সব কিছুই রয়েছে এখানে। পানির উপরে ভাসমান এই ধরণের সুবিধা দেখে দারুন লাগলো। বারান্দা থেকে ডাল লেক আর শ্রীনগর শহর দারুন সুন্দর লাগছিলো। রাতের খাবার আমরা হাউসবোটেই খেয়ে নেই। বাসায় কথা বলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। শুয়ে মাঝে মাঝে ভাবতেছিলাম যদি বিশাল বড় কোনো এনাকোন্ডা এসে হাজির হয় তখন কি করব?
শিকারা
শ্রীনগরে ডাল লেকের পানিতে ভেসে বেড়ানোর জন্য আছে বিশেষ ধরনের নৌকা যার নাম শিকারা। হাজার হাজার কালারফুল শিকারা প্রতিনিয়ত লেকে চলাচল করে বিভিন্ন প্রয়োজনে। আমরা রাতেই বোটের ম্যানেজার কে বলে রাখি আমাদের এমন দুইটা শিকারা দরকার। ঘন্টা অনুসারে তাদের ভাড়া। আমরা ৩০০ রুপি করে একেক শিকারা ১ ঘন্টার জন্য ভাড়া করে নিলাম।
সকলে ঘুম থেকে উঠেই দেখি শিকার এসে হাজির। আমরা ফ্রেশ হয়ে শিকারায় উঠে পড়লাম। শিকারায় করে আমরা ভাসমান বাগান, ভাসমান মার্কেটে গেলাম। একটু পরই দেখি অন্য শিকারা নিয়ে ফেরিওয়ালারা চলে আসছে। তারা জাফরান, বিভিন্ন কাশ্মীরি জিনিসপত্র বিক্রি করে। এরা খুব ডিস্টার্ব করে। এদের কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো। ডাল লেকে হাউসবোটে থাকা, শিকারায় ভেসে বেড়ানো কাশ্মীর ভ্রমণের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক ব্যাপার।
কাশ্মীরে শপিং
কাশ্মীরে কেনাকেটা করতে চাইলে শ্রীনগর থেকে কেনাই উত্তম। এখানেই অরজিনাল কাশ্মীরি জিনিসপত্র পাওয়া যায়। আমাদের ড্রাইভার আমাদেরকে এক বড় শোরুমে নিয়ে যায়। বিশাল বড় শোরুম। এখানে কাশ্মীরি শাল, মেয়েদের জামা, জ্যাকেট, বাচ্চাদের পোশাক ইত্যাদি প্রায় সব কিছুই রয়েছে। আর দামেও অনেক সস্তা।
আমি ঢাকার বাণিজ্য মেলা থেকে যে টাইপের কাশ্মীরি শাল ৩০০০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম তা দেখি এখানে ২৫০ রুপি। আমরা সবাই এখান থেকে নিজের এবং ফ্যামিলি মেম্বারদের জন্য অনেক কিছু কিনে নিলাম। এতো কিছু কিনছি দেখে এক মুরুব্বি সেলসম্যান অবাক হয়ে আমাকে বলে বাংলাদেশ তো আসলেই অনেক উন্নত হইছে। শুনে গর্ভে বুকটা ভরে যায়।
শ্রীনগর ভ্রমণ শেষে
সকালের ফ্লাইটে আমরা দিল্লি চলে আসি। আর এভাবেই শ্রীনগর ভ্রমণ এর মাদ্ধমে শেষ হয় আমাদের কাশ্মীর ট্যুর।
অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:
- পর্ব ১: লাদাখ এবং কাশ্মীর ভ্রমণ
- পর্ব ২: লাদাখের দর্শনীয় স্থান সমূহ
- পর্ব ৩: সড়ক পথে লেহ টু কার্গিল
- পর্ব ৪: সড়ক পথে কার্গিল টু সোনমার্গ
- পর্ব ৫: পৃথিবীর স্বর্গ সোনমার্গ
- পর্ব ৬: এশিয়ার সুইজারল্যান্ড পেহেলগাম
- পর্ব ৭: কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।