অনেক দিন থেকেই আমার হাউজ বোটে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আর যেতে পারিনি। তাই এইবার সুযোগ পেয়েই চলে আসি। হাউজ বোট (Houseboat) এ চড়ে বিশাল জলরাশির ওপর ভেসে ভেড়ানোর অনুভূতি, চারপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য, পাখিদের কলরব এবং হাওরের ঠাণ্ডা বাতাস সব মিলিয়ে এই ভ্রমণ ছিল খুবই রোমাঞ্চকর।
যাত্রার সূচনা
২২ শে আগস্ট, ২০২৪ ঢাকার আরামবাগ থেকে রাতের বাসে রওনা দিয়ে আমরা সকালে সুনামগঞ্জ শহরে এসে পৌঁছাই। উপজেলা অফিসের সামনে বাস থেকে নেমে পায়ে হেটে চলে যাই মল্লিকপুর ঘাট। সেখানে আগে থেকেই আমাদের জন্য জলকুমারী হাউজবোট ভাড়া করা ছিল। আমি বাংলাদেশ লোকাল গাইড কমিউনিটির সাথে এখানে গিয়েছিয়ালাম। তাই সব কিছুর ব্যবস্থা কমিউনিটির লোকজনই করেছিল।
ঘাটে এসে দেখি আমাদের জন্য সুন্দর একটি হাউজ বোট অপেক্ষা করছে। হাউজ বোটে ৫ টি রুম, ২ টি টয়লেট, মোবাইল চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা, ফ্যান সব কিছুই আছে। প্রতি রুমে ২ থেকে ৩ জন থাকা যায়। সামনের বড় রুমে ৫/৬ জন থাকা যায়। আমরা মোট ১১ জন এসেছি। যার যার রুমে ব্যাগ রেখে ছাদে চলে গেলাম। ছাদে বসার জন্য চেয়ার, চা, পানি, বিস্কুট সব কিছুই আছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই হাউজ বোট ছেড়ে দিলো। সুরমা নদী ধরে আমরা এগিয়ে চললাম টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে। আমাদের প্রথম গন্তব্য জিরো পয়েন্ট।
হাউজ বোট এ সকালের নাশতা
হাউজ বোটে প্রথমেই ওরা আমাদের শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করলো। সকাল ৮ টার দিকে নাশতা পরিবেশ করলো। নাশতায় চিকেন বিরানির মতো লোকাল একটা খাবার ছিল। সাথে বেগুন ভাজি, আচার, সালাদ, লেবু ছিল। হাউজ বোটের ছাদে বসে গরম গরম খাবার খেতে দারুন লাগে। এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা।
ধীরে ধীরে আমরা হাওরে প্রবেশ করি। আশেপাশের প্রকৃতি বদলাতে থাকে। বিশাল জলরাশির বুকে মানুষের বসতি, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁসের পাল, নীল আকাশ সব কিছু এক কথায় অপূর্ব। প্রকৃতি এতো সুন্দর হতে পারে এখানে না আসলে বুজতে পারতাম না।
জিরো পয়েন্ট
সকাল ১১:৩০ মিনিটের দিকে আমরা টাঙ্গুয়ার হাওর জিরো পয়েন্ট চলে আসি। জায়গাটি আসলে কোনো বর্ডার না। বিশাল পানির বুকে বেশ কিছু অর্ধ ডুবন্ত গাছ পালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকরা সাধারণত এই জায়গায় পানিতে নামে। জায়গাটি নিরাপদ। বোট থেকে লাইফ জ্যাকেট পরে ২০০ টাকা দিয়ে ছোট একটি নৌকা ভাড়া করে আমরা নেমে পরি।
ছোট নৌকায় চড়ে হাউজ বোট থেকে একটু দূরে গিয়ে সবাই পানিতে নামলাম। স্বচ্ছ শীতল পানিতে বেশ কিছুক্ষন গোসল করে চলে যাই ওয়াচ টাওয়ারে। টাওয়ার টি বেশ উঁচু। উপর থেকে আশেপাশের সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। বেশ কিছু ছবি তুলে নিচে নেমে আসলাম। অনেকেই আবার উপর থেকে পানিতে ঝাঁপ দিলো।
কিছুক্ষনের মধ্যে আরো হাউজ বোট চলে আসলো। সবাই পানিতে নেমে অনেক মজা করছে। যারা নামতে পারছে না তারা ছোট নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অল্প বয়স্ক মাঝিরা গান গেয়ে উনাদের আনন্দ দিচ্ছে। হাওরের পানিতে ভেসে ভেসে আমরা কফি খেলাম। কেউ কেউ ধুম্র পান করলো। ঘন্টা খানিক পর আমরা বোটে উঠে আবার যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নীলাদ্রি লেক।
নীলাদ্রি লেক
হাউজ বোটে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বিশাল জলরাশির বুক চিরে আমাদের বোট এগিয়ে চলে। উপরে নীল আকাশ, স্বচ্ছ জলে আকাশের প্রতিচ্ছবি, দূরে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড় -প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি যেন এক স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা। আশেপাশের গ্রাম থেকে ট্রলার নিয়ে দল বেঁধে লোকজন জুমার নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। আমরাও শ্রীপুর বাজারে থেমে নামাজ আদায় করে নিলাম।
নামাজ শেষ করে বোটে উঠে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাবারের মেন্যুতে ছিল ভাত, গরুর মাংস, বোয়াল মাছ, চেপা শুঁটকি, আলুর ভর্তা, সবজি, ডাল। খাবারের স্বাদ এক কথায় অসাধারণ। খাবার খেয়ে সবার গরম লেগে যায়। তাই একটু বিশ্রাম নিয়ে ৩ টার দিকে নীলাদ্রি লেকে নামি।
নীলাদ্রি লেক মূলত একটি পাথরের খনি। এক সময় এখন থেকে চুনা পাথর আরোহন করা হতো। যার ফলে বিশাল এক কৃত্তিম লেকের সৃষ্টি হয়েছে। লেক থেকে তোলা মাটির স্তূপ দেখতে ছোট ছোট পাহাড়ি টিলার মতো। জায়গাটি এতো সবুজ এবং সুন্দর যে অনেকেই একে বাংলার সুজারল্যান্ড বলে থাকে।
আমরা পুরো জায়গাটি ঘুরে দেখলাম, প্রচুর ছবি তুললাম। বিকাল ৫ টার দিকে বোটের কাছে ফিরে এসে দেখি অনেক বোট চলে এসেছে। বেশিরভাগ হাউজ বোট সাধারণ এখানে রাত্রিযাপন করে। ভীড় এড়াতে আমরা বারিক্কা টিলাতে রাত্রি যাপন করবো সিদ্ধান্ত নেই। তাই আবার যাত্রা শুরু করলাম।
হাউজ বোট এ যাদুকাটা নদীতে যাত্রী যাপন
চলতে চলতে হটাৎ করেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। গোধুলী লগ্নে পশু পাখিদের ঘরে ফেরা, বিশাল জলরাশির বুকে সূর্যের হারিয়ে যাওয়া এক কথায় অসাধারণ। বারেকের টিলা পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় ৯ টা বেজে যায়। যাদুকাটা নদীর তীরে বারেকের টিলার অপর পাশে সুবিধাজনক জায়গায় আমাদের হাউজ বোট নোঙ্গর করলো। ফ্রেশ হয়ে আমরা নদীর তীর দিয়ে বালুময় পথ ধরে কিছুক্ষন হাটাহাটি করি। আরো ১০/১২ টি হাউজবোট এখানে এসে থেমেছে। হটাৎ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আমরা দ্রুত বোটে চলে আসি।
যাদুকাটা নদীর বালুর তীর ক্যাম্পিং করার জন্য আদর্শ। কয়েকজনকে দেখলাম তাবু টানিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সবাই খুব টায়ার্ড তাই রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরি।
পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বোট থেকে নেমে নদীর পারে কিছুক্ষন হাটাহাটি করি। জায়গাটি খুবই সুন্দর। এক দিকে মেঘালয়ের উঁচু উঁচু পাহাড়, অপর পাশে বারেকের টিলা। মাঝখানে যাদুকাটা যদি। গ্রামের লোকজন এখানে নদী থেকে পাথর, বালি আরোহন করে। সকাল ৭:৩০ মিনিটের দিকে আমরা বারেকের টিলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সাধারণত এই সময় মানুষের ভীড় একটু কম থাকে।
বারেকের টিলা
ওপারে নেমে পায়ে হেটে আমরা চলে যাই বারেকের টিলা বা বারিক্কা টিলা। জায়গাটি সমতল থেকে একটু উঁচুতে। হাটতে না চাইলে বাইক নিয়েও উঠা যায়। বারেকের টিলা অসাধারণ সুন্দর। চারিদিকে সমতল জায়গা জুড়ে প্রচুর ছোট ছোট সবুজ গাছ। নিচে যাদুকাটা নদী। অপর পাশে মেঘালয়ের পাহাড়। এখানে ইচ্ছে করলে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। আমরা হেটে আরো উপরের দিকে উঠি। প্রায় ঘন্টা খানেক এখানে থেকে বোটে চলে আসি। টিলার নিচের দিকে নাশতা করার জন্য হোটেল আছে।
হাউজ বোটে ফিরে আমরা খিচুড়ি, ডিম, বেগুন ভাজি দিয়ে সকালের নাশতা খেয়ে নেই। পুনরায় পূর্বের জায়গায় এসে রেডি হয়ে যাদুকাটা নদীতে নেমে যাই। এখানে এসে নদীতে গোসল না করলে আপনার ট্যুর অসুম্পূর্ণ থেকে যাবে। সাঁতার না জানলে বোট থেকে জ্যাকেট নিয়ে নামতে পারেন। প্রায় ২ ঘন্টা যাদুকাটা নদীর শীতের পানিতে সাঁতার কেটে বোটে ফিরে আসি। পানিতে হালকা স্রোত ছিল।
শিমুল বাগান
বোটে ফিরে ফ্রেশ হয়ে শিমুল বাগানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা শিমুল বাগানের কাছে পৌঁছে যাই। বোট থেকে নেমে পায়ে হেটে বাগানের গেটে চলে যাই। জনপ্রতি ৫০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করি। এখানে কয়েক হাজার শিমুল গাছ সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো হয়েছে। যা দেখতে খুবই সুন্দর। বর্ষায় পুরো বাগান সবুজ রং ধারণ করে। আমরা বেশ কিছু ছবি তুললাম।
এখানে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। হাটতে হাটতে আমরা উত্তর দিকে যাদুকাটা নদীর পাশে চলে যাই। এই জায়গাটি অসাধারণ সুন্দর। নিচের দিকে ক্যাম্পিং করার ব্যবস্থা আছে। প্রায় ঘন্টা খানেক এখানে থেকে আমরা আবার বোটে ফিরে আসি।
ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরা
আপাতত আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের এখানেই সমাপ্তি। এবার ঘরে ফেরার পালা। তাই সুনামগঞ্জ শহরের উদ্দেশে আবার যাত্রা শুরু করি। পথে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। মেন্যুতে ভাত, হাওরের ছোট মাছ, রুই মাছ ছিল। খাবার খেয়ে সবার গরম লেগে যায়। তাই হাওরে নেমে আবার গোসল করে নেই। এমন শীতল পানিতে গোসল দারুন তৃপ্তির।
বিকালে হাউজ বোটের ছাদে বসে প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে ড্রাগন ফল খাই এবং চা পান করি। বিশাল টাঙ্গুয়ার হাওর খুবই বৈচিত্রময়। এর একেক দিক একেক ধরণের সুন্দর। সন্ধ্যায় ঘোড়ার পালের দৌড়ে দৌড়ে ঘরে ফেরা অনেকটা যেন কাশ্মীরে মতো। সন্ধ্যার পর পর আমরা সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছাই।
সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছে রাতের বাসে বাড়ি ফিরে আসি। আর এই ভাবেই শেষ হলো আমার টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।