সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮ লেহ। লাদাখে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন। গতকাল সকালেই আমরা ঢাকা থেকে লাদাখের লেহ শহরে এসেছি। আমরা কিভাবে এখানে আসলাম তা আমার আগের পোস্টে বিস্তারিত দেয়া আছে। আসুন শুনি আমার লেহ সাইটসিং এর অভিজ্ঞতা।
এখানে আমাদের হোটেল নিউ টাউন এলাকায়। হোটেলটি মোটামোটি ভালই। ওয়াইফাই, গরম পানি, টিভি ইত্যাদি সব কিছুই রয়েছে। সকালের নাস্তা আর রাতের খাবার সহ ডিলাক্স ডাবল বেডের প্রতিরুমের ভাড়া ১৫০০ রুপি। আসুন শুনি আমার লাদাখ ভ্রমণ কাহিনী এর দ্বিতীয় পর্ব।
AMS থেকে বাঁচতে কাল সারাদিন আমরা হোটেলে ঘুমিয়েই কাটিয়েছি। শুধুমাত্র সন্ধ্যার পর একটু মার্কেটে ঘুরতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আসার পথে আমাদের টিমের কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পরে। সাথেসাথেই হাসপাতাল নিয়ে যাই। ভাগ্য ভাল তেমন মেজর কোনো সমস্যা হয় নাই। তাই হোটেলে নিয়ে আসি। আসার পথে ১২০০ রুপি দিয়ে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে নেই।
লেহ সাইটসিং
রাতে বেশ ঠান্ডা পড়েছিল। সকালে তার থেকে আরো বেশি ঠান্ডা। এই ঠান্ডার মাঝেও গোসল করে রেডি হয়ে নেই। ৯ তার দিকে আমাদের গাড়ি চলে আসবে। আজ সকালে সবাই মোটামোটি সুস্থ এবং বাহিরে যাবার জন্য প্ৰস্তুত। আজ আমাদের লেহ সাইটসিং করার প্ল্যান আছে। এর জন্য আমরা ২৫০০ রুপি দিয়ে গাড়ি ভাড়া করেছি।
সকালে আমরা লাদাখী রুটি, ডিম, গাজরের আচার, চা ইত্যাদি দিয়ে নাস্তা শেষ নেই। নাস্তা শেষ করেই দেখি আমাদের গাড়ি চলে এসেছে। ১০ টার পর পর আমাদের গাড়ি চলা শুরু করল। ড্রাইভার মুজাফ্ফর গাড়িতে লাদাখী গান চালু করে দিল।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ম্যাগনেটিক হিল। ও ভালো কথা লাদাখে এই গরম আবার এই ঠান্ডা। তাই সাথে সেভাবেই জামাকাপড় নিবেন। ঠান্ডা লাগলে পড়বেন, গরম লাগলে খুলে ফেলবেন। ঠান্ডার জন্য এরা দেরি করে ঘুম থেকে উঠে। সকাল সকাল বের হতে চাইলে রাতেই বলে দিবেন।
ম্যাগনেটিক হিল লাদাখ
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা চলে আসলাম লেহ সাইটসিং এর প্রথম স্পট, ম্যাগনেটিক হিল (Magnetic Hill Ladakh)। দাগকাটা নির্ধারিত জায়গায় আসা মাত্রই ড্রাইভার স্টার্ট বন্ধ করে দিল। আর গাড়ি আপনা আপনিই সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। যদিও সামনের রাস্তাটি উঁচু হবার কারণে গাড়িটি পিছনে যাওয়ার কথা। বেপারটা দারুন লাগল।
এটি আসলে এক ধরণের অপটিক্যাল ইলুশন বা দৃষ্টি ভ্রম। জায়গাটি খুবই অসাধারণ। দুই পাশের সোনালী রঙের পাহাড় আর তার মাঝ দিয়ে সোজা কাল রঙের পিচ্ ঢালা পথ দেখতে দারুন। ছবি তোলার জন্য দারুন এক জায়গা। আমরা নেমে প্রচুর ছবি তুললাম, রাস্তায় গড়াগড়ি দিলাম। এখানে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। চাইলে নাস্তা করতে পারেন। আর এখানে কোয়াড বাইকিং এর ব্যবস্থা আছে। টাকা দিয়ে চালাতে পারেন, দারুন এক্সসাইটিং।
সঙ্গম পয়েন্ট
এর পর আমরা ম্যাগনেটিক হিল থেকে আরো প্রায় ৫ কিঃমিঃ সামনে এগিয়ে গেলাম। জায়গাটির নাম সঙ্গম পয়েন্ট। এখানে আসলে লাদাখের দুই নদী ইন্দুস আর জান্সকার এসে মিলিত হয়েছে। মূল জায়গাটি বেশ নিচুতে। আমরা একদম নিচে নদীর কাছে চলে গেলাম। জায়গাটি খুবই চমৎকার। নদীর জল ঘোলাটে এবং শীতল।
এখানে রাফটিং করার ব্যবস্থা আছে। সময় থাকলে চেষ্টা করতে পারেন। এখানে কিছু লাদাখী জিনিসপত্র পাওয়া যায়। কিনতে পারেন। এখানে কিছু সময় অতিবাহিত করে আমরা আবার লেহ শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। একটু উপরে উঠে আমরা আবার সঙ্গম ভিউ পয়েন্টে নেমে আরো কিছু ছবি তুললাম। উপর থেকে সঙ্গম পয়েন্ট এর ভিউ আরো সুন্দর।
গুরুদোয়ারা পাথর সাহেব
লেহ তে ফিরার পথে আমরা গেলাম শিখ ধর্মালম্বিদের এক ধর্মীয় স্থানে। এখানে সব সময় ফ্রিতে খাবার পরিবেশন করা হয় যাকে লঙ্গর বলে। সময় তখন দুপুর। আর ডিসকভারি চ্যানেলে এগুলা অনেক দেখেছি, তাই কৌতহলবসত ভিতরে প্রবেশ করি।
জুতা খুলে প্রবেশ করতেই তারা হলুদ কাপড় দিয়ে দিলো মাথায় বাধার জন্য। কাপড় মাথায় বেঁধে নিলাম। পথেই এমন ভাবে পানি দিয়ে রেখেছে যাতে ওই পানিতে না পাড়া দিয়ে সামনে কেউ আগাতে না পারে। পা ধুয়ে সামনে এগিয়ে প্লেট নিয়ে বসে গেলাম, একটু পরেই খাবার দিয়ে দিলো। এখানে খেয়ে নিজের প্লেট নিজেই পরিষ্কার করে রাখতে হয়।
এখানে একটা জিনিস বেশ ভালো লেগেছে। আমাদের দেশে সাধারণত কোন বাবার মাজারে যত টাকা পয়সা উঠে তার সব কিছুই বাবার লোকজন ভোগ করে। কেবল বছরে একবার আমজনতাকে খিচুড়ি খাওয়ায়। আর এরা দানের সব কিছু দিয়ে প্রতিদিন আগত মানুষদের ভোজন করায়।
পাশেই আর্মি ক্যাম্প থাকায় প্রচুর আর্মির লোকদেরও দেখলাম খাবার খেতে এবং স্বেচ্ছায় সেবা করতে। আর্মিরাই সব কিছু ম্যানেজ করে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। যাই হোক খাবারের টেস্ট কিন্তু তেমন একটা ভালো ছিলনা। ফ্রি বলে না, লাদাখের খাবার আসলে এমনই। আপনারাও এখান থেকে অবশ্যই লাঞ্চ করে নিবেন।
হল অফ ফেম
এর পর আমরা গেলাম হল অফ ফেম এ। এটি আসলে একটি আর্মি মিউজিয়াম। ইন্ডিয়ান আর্মিদের বিভিন্ন যুদ্ধের স্মৃতি, অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, সাজুয়াজান ইত্যাদি এখানে সাজানো রয়েছে। ভিতরে প্রবেশ করতে ২০রুপির টিকেট কাটা লাগে। সময় কম থাকায় আমরা কেবল বাহির থেকেই ছবি নিয়ে চলে আসি। এখানে একটা জিনিস খুব ভালো লাগল। মূলফটকেই আর্মির সোলজাররা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা ছবি তুলছি দেখে তারা আস্তে করে দুইপাশে চলে গেল। ব্যারটা একটু অন্যরকম লাগল।
থিকসে মনাস্ট্রি
এর পর আমরা গেলাম থিকসে মনাস্ট্রি তে। এটি লেহ শহর থেকে প্রায় ২০ কিঃমিঃ দূরে লেহ-মানালি হাইওয়েতে অবস্থিত। ভিতরে প্রবেশ করতে ৩০রুপির টিকেট কাটা লাগে। আমরা টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করি এবং বিভন্ন কক্ষ পরিদর্শন করি। সিঁড়িদিয়ে আমরা একদম ছাদে উঠে যাই। ছাদ থেকে আশেপাশের ভিউ অস্থির সুন্দর। এর পর আমরা আবার লেহ শহরের দিকে ফিরতে থাকি।
থ্রি ইডিয়টস স্কুল
এর পর আমরা গেলাম আমির খানের সেই বিখ্যাত মুভি “থ্রি ইডিয়টস” এর থ্রি ইডিয়টস স্কুলে। থ্রি ইডিয়টস মুভির কারণে এটি এখন একটি ভাল ট্যুরিস্ট স্পট। স্কুল কতৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ট্যুরিস্টদের জন্য নির্ধারিত সময়ে মুভির শুটিং স্পট গুলো ভিসিট করা যায়।
আমরা ভিতরে প্রবেশ করে সেই বিখ্যাত ইডিয়টিক ওয়াল এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি এবং স্কুলের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করি। এখানে একটি ক্যাফে রয়েছে যেখানে নানান ধরণের খাবার পাওয়া যায়। আমরা দুপুরের লাঞ্চ এখানেই সেরে ফেলি। এখানকার খাবার একদম ফ্রেশ, অসাধারণ তার টেস্ট।
সে প্যালেস
ফিরার পথে এর পর আমরা গেলাম সে প্যালেস (Shey Palace Leh) এ। একসময় এটি লাদাখের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল। পুরা কমপ্লেক্স একটি টিবির উপর অবস্থিত। প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক আসে একে দেখার জন্য। বাহির থেকে দেখতে অনেকটা সিরিয়ার বিদ্ধস্ত কোনো প্রাসাদের মতো মনে হলেও সে প্যালেস খুবই সুন্দর।
লেহ প্যালেস
এর পর আমরা গেলাম লেহ প্যালেস (Leh Palace) এ। এটি লেহ শহরে এক পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। এই ভবনটি এক সময় লাদাখ রাজ্যের রয়েল প্যালেস ছিল। বর্তমানে এটি মিউজিয়াম এবং প্রবেশ ফি দিতে হয়। লেহ প্যালেস এর ছাদ থেকে লেহ শহর এবং আশেপাশের এলাকার সুন্দর প্যানোরোমিক ভিউ পাওয়া যায়।
শান্তি স্তুপা
এর পর আমরা গেলাম লেহ শহরে অবস্থিত বৌদ্ধ ধর্মের এক ধর্মীয় স্থানে, যার নাম শান্তি স্তুপা (Shanti Stupa)। এখান থেকে পুরা লেহ শহরের সুন্দর এবং আশেপাশের এলাকার দারুন প্যানোরোমিক ভিউ পাওয়া যায়। আমরা সন্ধ্যার আগে যাই এবং সন্ধ্যার পর আরো কিছুক্ষন থাকি। তখন তাপমাত্রা কম করে হলেও মাইনাস ৪-৫ ডিগ্রী হবে। ঠান্ডায় একেকজন রীতিমতো থর থর করে কাঁপতেছিলাম।
লেহ মার্কেট
এর পর আমরা রুমে চলে আসি। ফ্রেশ হয়ে আবার চলে যাই লেহ সিটি মার্কেটে (Leh City Market)। এটি লাদাখ এলাকার সব থেকে বড় মার্কেট। শান্তি স্তুপায় ঠান্ডা খেয়ে আমরা সবাই এখন থেকে আরো কিছু শীতের কাপড় কিনে নেই। দামও খুব একটা বেশি না। এখানে my father was in Ladakh, my brother was in Ladakh, my sister was in Ladakh ইত্যাদি নানান ধররের লেখা সম্বলিত টিশার্ট পাওয়া যায়। দাম ৩০০-৪০০ রুপি। আমরা কয়েকটা কিনে নিলাম। এখানকার আপেলের টেস্ট কিন্তু দারুন, খেতে মিস করবেন না।
অনেক্ষন ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত, তাই ভাবলাম চা বা কফি কিছু খাই। পাশের এক চা দোকানে গেলাম চা খেতে। এদের চা বানানোর সিস্টেম দেখে পুরাই অবাক। এরা আমাদের মতো চা পাতা পানিতে দিয়ে সারাক্ষন জাল দিতে থাকেনা। কেউ অর্ডার করলে তার জন্য যে পরিমান দরকার সে পরিমান পানি দিয়ে তখনই চা বানিয়ে দেয়। এবং বানানো শেষে চুলা বন্ধ করে রাখে। এখানকার সব রেস্টুরেন্ট এর খাবারের সিস্টেমও একই। অর্ডার করার পরেই তরকারি নতুন করে রান্না করে। একটু সময় লাগে, কিন্তু সব কিছু একদম ফ্রেশ।
লেহ সাইটসিং শেষে
লেহ তে সবাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরে, দোকান পাট মোটামোটি ৮ থেকে ৮:৩০ আর মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়। তাই আর দেরি না করে হোটেলে ফিরে আসি। এসে মুরগি, ডিম, সবজি, ডাল আর ভাত খেয়ে নেই। আমাদের হোটেলের ম্যানেজার মুসলিম। তাই তাকে আগেই বলে দিয়েছিলাম আমাদের সব কিছু যাতে মুসলিম তরিকায় রান্না করা হয়।
রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে বাসার সবার সাথে কথা বলে, কিছু ছবি ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। কাল সকালে আবার লম্বা জার্নি আছে লেহ টু শ্রীনগর আর এভাবেই লেহ সাইটসিং এর মাধ্যমে লাদাখে শেষ হলো আমাদের দ্বিতীয় দিন। ।
লেহ সাইটসিং এর বাহিরে
লেহ তে ঘুরার মতো আরো কিছু জায়গা আছে। কিন্তু সময় কম থাকার কারণে আর কোথাও যেতে পারিনাই। একদিনে আসলে এর বেশি সম্ভবও না। নুব্রা ভ্যালি, প্যাংগং লেক, খারদুংলা পাস, তুর্তুক গ্রাম এ যেহেতু আমাদের আপাদত যাবার অনুমতি, নাই তাই এবার এগুলা বাদ। পরবর্তীতে আবার লাদাখ যাবার ইচ্ছা আছে। তখন বাকি গুলা টাচ করবো।
তবে লেহ তে কিছু দালাল আছে যারা ডিসি অফিস থেকে অনুমতি ম্যানেজ করে দেয় টাকার বিনিময়ে। এরা মূলত পরিচয় গোপন করে কলকাতার লোক হিসাবে নিয়ে যায়, যা খুবই রিক্সি। একবার ধরা পড়লে খবর আছে। আমাদেরকেও অনেকে এই অফার দিয়েছিল।
তবে অন্য দেশের আইডেন্টিটি নিয়ে যেতে বিবেকে বাধা দিল। তাই আর ওই দিকে যাই নাই। যদি কখনো ওপেন করে তাহলে যাব একদিন। তবে খুশির খবর হচ্ছে এখন ঢাকা থেকে এই অনুমতি সহজে পাওয়া যায়। বসুন্ধরা ইন্ডিয়ান ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টারে ৩০০ টাকার বিনিময়ে এই অনুমতি পাওয়া যায়। তার জন্য অবশ্য আপনার ইন্ডিয়ান ভিসা এবং তার মেয়াদ থাকতে হবে।
অন্য পর্ব গুলোও দেখে নিতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে:
- পর্ব ১: লাদাখ এবং কাশ্মীর ভ্রমণ
- পর্ব ২: লাদাখের দর্শনীয় স্থান সমূহ
- পর্ব ৩: সড়ক পথে লেহ টু কার্গিল
- পর্ব ৪: সড়ক পথে কার্গিল টু সোনমার্গ
- পর্ব ৫: পৃথিবীর স্বর্গ সোনমার্গ
- পর্ব ৬: এশিয়ার সুইজারল্যান্ড পেহেলগাম
- পর্ব ৭: কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর
সময়ে নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আশা করি খুব উপভোগ করেছেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টস করে জানালে ভালো হয়। আর ভালো লেগে থাকলে ওয়ালে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।