ছেঁড়া দ্বীপ (Chera Dwip; Chera Dip) দেশের দক্ষিণ দিকের সবশেষ ভূখণ্ড। এটি সমুদ্রের নীল জলরাশি, প্রবাল পাথর এবং সারি সারি নারিকেল গাছ নিয়ে অপার সৌন্দর্যের এক নির্জন দ্বীপ। দূর থেকে দেখে মনে হয় সাগরে ভাসমান এক বন। জোয়ারের সময় এর এক-তৃতীয়াংশ পানিতে তলিয়ে যায়।
ছেঁড়া দ্বীপ কোথায় অবস্থিত
ছেঁড়া দ্বীপ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত। দ্বীপটি সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ এর আওতাধীন। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এর অবস্থান। এটি সেন্টমার্টিনেরই অংশ। জোয়ারের সময় এই দ্বীপের এক তৃতীয়াংশ পানিতে ডুবে যায়। আর মূল দ্বীপ-ভূখণ্ড থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। এজন্যই এর নাম ছেঁড়া দ্বীপ। ছেঁড়া অর্থ বিচ্ছিন্ন বা আলাদা।
ছেঁড়া দ্বীপ এর আয়তন কত
ছেঁড়া দ্বীপের আয়তন প্রায় ৩ কিলোমিটার। এখানে ১০০ থেকে ৫ বর্গমিটারের কয়েকটি দীপ রয়েছে। এগুলোকে স্থানীয় লোকজন ‘ছেঁড়াদিয়া’ বা ‘সিরাদিয়া’ বলে থাকে। এই এলাকাটি সরকার ‘পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। এখানে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানায় জমি কেনা, এমনকি কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ।
ছেঁড়া দ্বীপ কিভাবে যাবেন
ছেঁড়া দ্বীপ যেতে হলে আপনাকে প্রথমেই আসতে হবে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ। রাজধানী ঢাকা থেকে বাসে করে সরাসরি টেকনাফে যাওয়া যায়। ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির এসি/নন এসি বাস সরাসরি টেকনাফ যায়। এদের মধ্যে শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন, ঈগল, এস আলম, মডার্ন লাইন, গ্রীন লাইন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাসে সময় নিবে ১০/১২ঘন্টা। বাস ভাড়া ৯০০ থেকে ২৫০০ টাকা।
টেকনাফ থেকে যেতে হবে সেন্টমার্টিন। প্রতিদিন বেশ কিছু জাহাজ টেকনাফ-সেন্টমার্টিনে রুটে আসা-যাওয়া করে। তাদের মধ্যে কুতুবদিয়া, কেয়ারী সিন্দাবাদ, ঈগল, সুন্দরবন ও গ্রীনলাইন ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য। জাহাজগুলো সকাল ৯.০০ থেকে ৯.৩০ মিনিটে টেকনাফ থেকে ছেড়ে যায়। বিকাল ৩.০০ থেকে ৩.৩০ মিনিটে সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়ে যায়। তাই সময়ের আগে জেটি ঘাটে উপস্থিত না হতে পারলে জাহাজ মিস হবার সম্ভাবনা আছে।
সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়া দ্বীপ
সেন্টমার্টিনের জেটির কাছ থেকে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার ইঞ্জিন চালিত গান বোট ও স্পিড বোট পাওয়া যায়। গান বোট ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। গান বোট রিজার্ভ ভাড়া ২,০০০ টাকা, স্পিড বোট রিজার্ভ ভাড়া ৩,০০০ টাকা। এছাড়া দ্বীপের পশ্চিম পাশ থেকেও মোটর সাইকেল, বাই সাইকেল এবং গান বোট দিয়ে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়া যায়।
কটেজের নিচেই মোটর সাইকেল চালকেরা বাইক নিয়ে ঘুরোঘুরি করে। প্রতি ঘন্টা মোটর সাইকেল ভাড়া ৫০০ টাকা। প্রতি ঘন্টা বাই সাইকেল ভাড়া ৪০ টাকা। গান বোট ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা। গান বোটের লোকজন কটেজ গুলোতে এসে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার লোকজন খুঁজতে থাকে।
এছাড়া পায়ে হেঁটে বা পূর্ব পাশ দিয়ে সাইকেল চাইলিয়ে ছেঁড়া দ্বীপ যেতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই জোয়ার ভাটার সঠিক সময় জেনে নিবেন। স্থানীয় লোকজন বা হোটেল থেকে জোয়ার ভাটার সময় জেনে নিতে পারেন।
তবে মোটর সাইকেল বা বাই সাইকেল নিয়ে সরাসরি ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়া যায় না। প্রশাসন থেকে নিষেধ করা আছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের সর্ব দক্ষিণে ছেঁড়া দ্বীপ সংলগ্ন পয়েন্টে সাইকেল রাখার জায়গা আছে। নির্ধারিত ফি দিয়ে টোকেন নিয়ে পায়ে হেটে চলে যাবেন ছেঁড়া দ্বীপ।
কখন যাবেন
আপনি যদি ওই দিন টেকনাফ ফিরে আসার প্ল্যান থাকে, তাহলে খুব সকালে চলে যাবনে ছেঁড়া দ্বীপ। চেষ্টা করবেন সকাল ৮ টার পূর্বেই ছেঁড়া দ্বীপ থাকতে। তবে যদি ওই দিন না ফিরে আসেন, তাহলে দুপুর ১২ দিকে রওনা দিবেন। কেননা ১২ টার পর থেকে জোয়ার কমতে থাকে। কোরাল গুলো সব ভেসে উঠে।
ছেঁড়া দ্বীপে কি করবেন
এখানে বেশ কয়েকটি দীপ পরস্পরের সাথে কানেক্টেড। সব গুলো পায়ে হেটে দেখতে পারেন। বিভিন্ন পয়েন্টে ছবি তুলতে পারেন। দক্ষিণ পাশের দ্বীপের উত্তর পাশের জল খুবই স্বচ্ছ এবং নীল। এখানে গোসল করতে পারেন। এখানকার পানির ঢেউ খুবই সুন্দর। কোরালের সাথে বালি আছে। তাই পানিতে নামা নিরাপদ। তবে বেশি দূরে যাবেন না।
কোথায় থাকবেন
ছেঁড়া দ্বীপে থাকার কোনো ব্যবস্থা নাই। বিকেল চারটার পর এই দ্বীপে অবস্থান করা নিষিদ্ধ। থাকতে হলে সেন্টমার্টিন অথবা কক্সবাজারে যেয়ে থাকতে হবে। থাকার জন্য সেন্টমার্টিন এবং কক্সবাজারে অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেন্টমার্টিনের কিছু হোটেল এবং কটেজের তথ্য নিচে দেয়া হলো:
- কোরাল ভিউ রিসোর্ট (Coral View Resort): ভাড়া ৩০০০/৬৫০০ টাকা। ফোন ০১৯৮০০০৪৭৭৮, ০১৭১৩১৯০০১৩
- ব্লু মেরিন রিসোর্ট (Blue Marine Resort): ভাড়া ২৫০০/৬০০ টাকা। ফোন ০১৭১৩-৩৯৯০০১, ০১৮১৭-০৬০০৬৫
- প্রাসাদ প্যারাডাইস রিসোর্ট (Praasad Paradise Resort): ভাড়া ২৫০০/৬০০ টাকা। ফোন ০১৯৯৫-৫৩৯২৪৮, ০১৮৮৩-৬২৬০০৩
- নীল দিগন্তে রিসোর্ট (Neel Digante Resort): ভাড়া ১৫০০/৫০০০ টাকা। ফোন ০১৭৩০-০৫১০০৪
আরো পড়তে পারেন সেন্ট মার্টিন এর সকল হোটেল, রিসোর্ট এবং কটেজ এর তথ্য।
কোথায় খাবেন
ছেঁড়া দ্বীপে ২/৩ টি ভাম্যমান দোকান, যেখানে পানি, চিপস, ডাব, তরমুজ ছাড়া আর কিছু নাই। খেতে হলে সাথে খাবার নিয়ে যেতে হবে। অথবা সেন্টমার্টিন এসে খেতে পারেন। এখানে সব কিছুর দাম বেশ চড়া। ডাবের দাম ৮০ টাকা। তবে যাই খান ময়লা আবর্জনা নির্ধারিত ডাস্টবিনে ফেলবেন। এখানে খাবারের দোকানের পাশে বেশ কিছু ডাস্টবিন রাখা আছে।
সেন্টমার্টিনে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ আছে। তাদের মধ্যে আসলাম হোটেল, হোটেল আল্লার দান, কেয়ারি মারজান রেস্তোরাঁ, কুমিল্লা রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সেন্টমার্টিনে কোরাল, ইলিশ, রূপচাঁদা, লবস্টার, কালাচাঁদা, সুন্দরী পোয়া ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। খেয়ে দেখতে পারেন।
সতর্কতা এবং টিপস
- ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না।
- কোরাল বা প্রবাল তুলে সাথে নিয়ে আসবেন না।
- কোরাল অনেক ধারালো। পা কেটে যেতে পারে। তাই হাঁটার সুবিধার্থে কেড্স জুতো পরে যাবেন।
- তবে পানিতে নামার জন্য রাবারের জুতো ব্যবহার করতে পারেন।
- এখানে সব কিছু বাহিরে থেকে আসে। তাই সব কিছুর দাম অনেক বেশি।
- ৩ দিনে জন প্রতি খরচ হবে ৫,০০০/৬,০০০ টাকা। তবে টিমের সাইজ বড় হলে ৩,০০০/৪,০০০ টাকায় ঘুরে আসতে পারবেন।
- খরচ কমাতে ছুটির দিন এড়িয়ে চলুন।
আরো দেখে নিতে পারেন সেন্টমার্টিন নিয়ে কমন কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর। আপনার ভ্রমণ সুন্দর এবং সহজ হউক।
লেখক
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও ঘুরে বেড়াতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কে এই ওয়েব সাইটে নিয়মিত শেয়ার করি।